উত্তরার একটি মসজিদে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ

কামরান রেজা চৌধুরী
2024.01.22
ঢাকা
উত্তরার একটি মসজিদে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। গাজীপুর, ২০ জানুয়ারি ২০২৪।
[জীবন আহমেদ/বেনারনিউজ]

বিশ্ব ইজতেমার আগেই ঘটল সংঘর্ষের ঘটনা। উত্তরার একটি মসজিদে আধিপত‌্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রোববার রাতে তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ১০জন আহত হয়েছে। এরই জেরে সোমবার ওই মসজিদে দুই গ্রুপের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

মসজিদুল তাকওয়া নামে ওই মসজিদের ইমাম মুফতি মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহ বেনারকে বলেন, সোমবার থেকে ওই মসজিদে বিবদমান মাওলানা জুবায়ের এবং মাওলানা সাদ সমর্থক কোনো পক্ষকেই ইসলামি দাওয়াত পরিচালনা করতে দেওয়া হচ্ছে না।

বিশ্ব ইজতেমার আগে আবার সংঘর্ষে জড়ালে সরকার বিষয়টি কঠোরভাবে দমন করবে বলে বেনারকে জানিয়েছেন ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক খান।  দুই বিবদমান গ্রুপকে বিষয়টি বলা হয়েছে বলে জানান তিনি।

মাওলানা জুবায়ের সমর্থকদের অভিযোগ, তাঁরা মসজিদুল তাকওয়া ইসলাম প্রচারের জন‌্য আগে থেকে কাজ করে আসছেন।  সাদ সমর্থকেরা ওই মসজিদ দখলে নিতে চাইলে সংঘর্ষের সূচনা হয়

বিপরীতে সাদ সমর্থকেরা বলছেন, তাঁরা আল্লাহর ঘর মসজিদে ইবাদত করতে গেলে মাওলানা জুবায়েরপন্থীরা তাঁদের ওপর আক্রমণ চালায়।

উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হাসান সোমবার বেনারকে বলেন, রোববার রাতে তাবলিগ জামাতের মাওলানা সাদপন্থী এবং মাওলানা জুবায়েরপন্থী সমর্থকদের মধ‌্যে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।  তবে তিনি সংখ্যা জানাতে পারেননি।

তিনি জানান, মসজিদুল তাকওয়ায় দুই গ্রুপই অবস্থান নিতে গেলে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।  এই ঘটনায় কোনও মামলা হয়নি বলে জানান তিনি

মুফতি মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহ সোমবার বেনারকে বলেন, মসজিদে তাবলিগ জামাতের মাওলানা জুবায়েরের সমর্থকরা ইবাদত করেন, ইসলাম নিয়ে কাজ করে থাকেন। তাঁরা মসজিদ কমিটির কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে এই কাজ করে আসছেন গত কয়েক বছর ধরে

তিনি বলেন, রোববার দুপুরে মাওলানা সাদপন্থী তাবলিগ জামায়াতের সদস‌্যরা ওই মসজিদে আসেন।  রাতে এশার নামাজের পর তারা নামাজ পড়ে ইবাদত শুরু করেন।  দুই পক্ষ মসজিদের দুই দিকে অবস্থান নেন।

মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, “আমি বিষয়টি বুঝে মুসল্লিদের উদ্দেশ‌্যে বলি, তাঁরা যেন কোনোভাবেই সংঘাতে জড়িয়ে না পড়েন।”

আমি মসজিদ থেকে চলে যাওয়ার পর সেখানে দুই পক্ষের মুসল্লিরা নিজেদের মধ‌্যে সংঘাতে লিপ্ত হন।”

ফয়জুল্লাহ বলেন, “এই ঘটনার পর পুলিশ ও প্রশাসনের লোকেরা এসে বলে দিয়েছে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কোন পক্ষই মসজিদে তাদের কার্যক্রম চালাতে পারবেন না। এখন মসজিদে কোনও পক্ষের মুসল্লি নেই।  কেবলমাত্র সাধারণ মুসল্লিরা নিয়মিত নামাজ আদায় করছেন।”

মাওলানা সাদপন্থী তাবলিগ জামাতের সাথি মো. মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “কোন প্রকার উস্কানি ছাড়াই মসজিদুল তাকওয়ায় অবস্থানকারী আমাদের ২৫ জন সাথিকে জুবায়েরপন্থী লোকেরা আক্রমণ করেছে।  কমপক্ষে ১০ সাথি মারাত্নকভাবে আহত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর।”

তিনি বলেন, “তারা মসজিদুল তাকওয়াকে তাদের নিজেদের সম্পত্তির মতো করে ধরে রেখেছে।  আমাদের সাথিরা সেখানে দাওয়াত দিতে গেলে তাদের বের করে দেওয়া হয়।”

কেন তাদের সাথিদের আক্রমণ করা হয় এমন প্রশ্নের জবাবে মিজানুর রহমান বলেন, “আমরা দাওয়াত দিলে তাদের যে ইজতেমা (২ ফেব্রুয়ারি) হবে সেখানে মানুষ যাবে না। মানুষ আমাদের ইজতেমায় আসবে।  এটিই তাদের সমস্যা।”

তবে জুবায়েরপন্থী সিনিয়র নেতা মো. জাকারিয়া এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমি আপাতত এই বিষয়ে কোন কথা বলতে চাই না।”

ঢাকার অদূরে গাজীপুর জেলার টঙ্গী ইজতেমার মাঠে বাৎসরিক বিশ্ব ইজতেমাকে হজের পরেই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জমায়েত।  বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ইজতেমায় অংশ নিতে বাংলাদেশে আসেন

ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক খান সোমবার বেনারকে বলেন, “গত কয়েক বছর ধরে বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে তাবলিগ জামাতের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি জানান, এই বিভেদের কারণ নিজেদের মধ্যে মতানৈক্য। এক গ্রুপের নেতা হচ্ছেন মাওলানা সাদ যিনি দিল্লিতে থাকেন।  অন্য গ্রুপের নেতা হচ্ছেন বাংলাদেশের মাওলানা জুবায়ের।  এক সময় ওনারা দুজন একসাথে তাবলিগ জামাত পরিচালনা করতেন।

মন্ত্রী জানান, বর্তমানে এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে ‘বিদাত’ বলে চিহ্নিত করে দোষারোপ করে এবং সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

 “এ কারণে সরকার দুই গ্রুপের জন্য ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ইজতেমার তারিখ দিয়ে আসছে।”

মন্ত্রী জানান, এক গ্রুপ ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি এবং অন্য গ্রুপ ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুটি পৃথক ইজতেমা আয়োজন করবে।

ফরিদুল হক খান জানান, “সোমবার সরকারের পক্ষ থেকে আমি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের দুই পক্ষের সাথে সভা করেছি।  বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন নিয়ে কথা বলেছি।  একইসাথে তাদের সতর্ক করা হয়েছে।”

তিনি বলেন, “সভায় আমরা বলেছি, ‘আপনারাই মারামারি, হানাহানি করতে নিষেধ করেন। কিন্তু আপনারাই মারামারি করছেন।  এরপর যদি এমন আচরণের পুনরাবৃত্তি হয় তাহলে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে।”

ভারতের মাওলানা সাদ কান্দালভীর একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ২০১৭ সালে তাবলিগ জামাতের নেতাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়।  কান্দালভী তাবলিগ জামাতে কিছু সংস্কারের কথা বলে আসছিলেন।  তার একটি বক্তব্য ছিল যে "ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রচারণা অর্থের বিনিময়ে করা উচিত নয়"।

অনেকেই মনে করেন যে এই বক্তব্যের মাধ্যমে মিলাদ বা ওয়াজ মাহফিলের মতো কর্মকাণ্ড পরিচালনার বিনিময়ে অর্থ নেয়ার বিপক্ষে বলা হয়েছে।

সাদ কান্দালভী সে সময়ে আরও বলেছিলেন, "মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষকদের মাদ্রাসার ভেতরে নামাজ না পড়ে মসজিদে এসে নামাজ পড়া উচিত, যাতে মানুষের সাথে যোগাযোগ বাড়ে।"

এসব বক্তব্য ভারতে তাবলিগ জামাতের একাংশকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। বিশেষ করে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ তার বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে। দারুল উলুম দেওবন্দ-এর সাদ বিরোধী অবস্থান প্রকাশ্য হওয়ার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও।  বিভক্ত হয়ে পড়েন বাংলাদেশের তাবলিগ জামাতের শীর্ষ নেতারা।

কান্দালভীর এসব বক্তব্য  আহলে সুন্নাত ওয়া'ল জামাতের বিশ্বাস ও আকিদার বাইরে বলে মত দেন তার বিপক্ষের অংশ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।