থাইল্যান্ডের গণকবরে ঠাঁই হয়েছে ভাগ্যান্বেষী বাংলাদেশিদের

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.05.04
Thai-trafficking থাই-মালায়েশিয়া সীমান্তে পাচারকারীদের বন্দি-শিবিরে খুঁজে পাওয়া একমাত্র জীবিত বাংলাদেশি এখন সংখলায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তারনাম থু দন খা বলা হলেও ব্যাঙ্কক পোস্ট জানায় তার নাম তুনুসার। ৪ মে, ২০১৫
এএফপি

থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গল থেকে ১১৮ বাংলাদেশি বন্দিদশা থেকে মুক্তির ছয় মাসের মাথায় এবার দেশটির  গণকবর থেকে উদ্ধার হলো বাংলাদেশিদের লাশ। জীবিকার তাগিদে দেশ ছেড়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে মানবপাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে থাইল্যান্ডেই তাদের জীবন দিতে হয়েছে।

দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, মানবপাচারকারী এই চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া এ চারটি দেশের মাফিয়ারা সক্রিয়ভাবে যুক্ত। দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা দালালরা বিদেশে যেতে চায় এমন তরুণ-যুবকদের ভালো কাজের লোভ দেখিয়ে কক্সবাজার, কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় গডফাদারদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে।

তারপর এরা হাতবদল হয়ে প্রথমে থাইল্যান্ড ও সবশেষে মালয়েশিয়ার গডফাদারদের খপ্পরে পড়ছেন। এদের অনেকে মালয়েশিয়া পৌঁছানোর আগেই প্রাণ হারান, অনেকে কোনো দিন দেশে ফিরতে পারেন না আর।

গত শুক্রবার মালয়েশিয়া সীমান্তের কয়েকশ মিটার দূরে থাইল্যান্ডের সাদাও জেলার পাদাং বেসারের এক পাহাড়ি এলাকা থেকে একসঙ্গে ২৬টি মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। একদিন পর এই সংখ্যা ৫০টি ছাড়ায়। গত রোববার আরেকটি নতুন ঘাঁটির সন্ধান পাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সেখানেও আছে অভিবাসীদের অনেক কবর।

এর আগে গত শুক্র ও শনিবার দুই দিনে উদ্ধারকৃত লাশগুলোর মধ্যে অন্তত ১০ জন বাংলাদেশি নাগরিক ছিলেন বলে জানিয়েছেন সেখান থেকে জীবিত উদ্ধার হওয়া এক বাংলাদেশি।

বার্তা সংস্থা এএফপি পুলিশের ফরেনসিক দলের প্রধান জারামপর্ন সুরা মানিকে উদ্ধৃত করে জানাচ্ছে, ‘মৃতদেহগুলোর একটি একজন নারীর। তবে এদের মৃত্যুর কারণ এখন পর্যন্ত অজানা।’

মৃত্যুর কারণ জানা না গেলেও এরা যে বন্দী ছিলেন সে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি জানান, এলাকাটি ছিল সত্যিকার অর্থেই জেলখানার মতো। মৃতদেহগুলো বিকৃত হয়ে গেছে। মানুষগুলোকে ময়লা আবর্জনার ভেতরে পুঁতে ফেলে ওপরে বাঁশ ফেলে রাখা হয়েছিল।

গণকবরের পাশ থেকে আনুজার নামের এক বাংলাদেশিকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। ব্যাংকক পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আনুজার বলেন, ‘এই বন্দিশিবিরে যারা মারা গেছেন তাদের কমপক্ষে ১০ জন বাংলাদেশি। এছাড়াও ছিল ৩০ জন রোহিঙ্গা। আট ব্যক্তি বন্দিশিবিরটি চালাত। এদের কেউ কেউ ছিল রোহিঙ্গা আবার কেউ মালয়েশীয়।’

আনুজার আরও বলেন, মুক্তিপণ আদায় না হওয়া পর্যন্ত বন্দীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন করা হতো। খাবার বা পানি দেওয়া হতো না ঠিকমতো। তাঁরা কদাচিৎ গোসলের সুযোগ পেয়েছেন।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এই বাংলাদেশি আরও জানান, কক্সবাজার থেকে অপহরণের পর তাঁকে জোরপূর্বক কয়েক বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গার সঙ্গে নৌকায় তুলে দেওয়া হয়। পরে থাইল্যান্ডের ওই বন্দিশিবিরে এনে পাচারকারীরা তাঁকে দিয়ে বাড়িতে ফোন করিয়ে মুক্তিপণ চায়।

“থাইল্যান্ডে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে ‘বাংলাদেশি’ আনুজারের সঙ্গে তাদের একটি প্রতিনিধিদলের জরুরি সাক্ষাৎ করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছে। থাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এ বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। সরকারের তরফ থেকে আনুজারের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করা হচ্ছে,” বেনারকে জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা খালেদা বেগম।

ব্যাংকক পোস্ট ৪ মে ‘ডিটেনশন ক্যাম্প হরর গ্রোস’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরেক বাংলাদেশির সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। তুনুসার নামের ওই ব্যক্তি জানান, ‘অপুষ্টিতে না খেতে পেয়ে এবং দিনের পর দিন নির্যাতনের শিকার হয়ে ওরা মারা গেছে।’

তুনুসার পুলিশকে কয়েকজন দালালের নাম জানিয়েছেন। এরা হলো হাই, আমারতলি, আরনুয়া, সালিম, রানা ও হায়দ্রা। চিকিৎসাধীন অপর এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আরনুয়াকে তিনি নিজে কাসিম নামের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করতে দেখেছেন।

ব্যাংকক পুলিশ ২৯ এপ্রিল আরনুয়াকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে রোহিঙ্গা অ্যাসোসিয়েশন ইন থাইল্যান্ডের সভাপতি আবুল কালাম বলেছেন, ‘থাই-মালয়েশিয়া সীমান্তে এ রকম কমপক্ষে ৬০টি বন্দিশিবির আছে। এগুলোর এক একটিতে ১৫০ থেকে ৮০০ বন্দী আছেন। যতটুকু জানা গেছে তা খুবই সামান্য।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মালয়েশিয়া পাঠানোর নাম করে দালালরা প্রথমে ৪০/৫০ হাজার টাকা নিচ্ছে। সমুদ্রপথে থাইল্যান্ডে পৌঁছানোর পর পাচার হয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে গহিন জঙ্গলে আটকে রেখে তাদের পরিবারের কাছ থেকে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত মুক্তিপণ আদায় করছে।

যেসব পরিবার মুক্তিপণের টাকা দিতে পারছে না, তারাই স্বজন হারাচ্ছে। হয় তাদের মেরে ফেলা হচ্ছে, নয়তো ক্রীতদাস হিসেবে কাজ করানো হচ্ছে।

“মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে জনশক্তি রপ্তানির চুক্তি হওয়ার পর দালালেরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দালালেরা তরুণ-যুবকদের বোঝাচ্ছে, সরকারিভাবে যেতে অনেক বেশি সময় লাগে। একই টাকায় বেসরকারিভাবে যাওয়া সম্ভব। থাইল্যান্ডে পৌঁছানোর পর যে টাকা আদায় করা হবে সে কথাটা চেপে যাচ্ছে,” বেনারকে জানান অভিবাসী মালয়েশিয়া ফেরত শ্রমিক আল আমিন নয়ন।

জাতিসংঘ গত বছরের জুনে ‘ক্রীতদাস প্রথা’ নিরসনে ব্যর্থ হওয়ায় থাইল্যান্ডের প্রতি নিন্দা জানায়। যুক্তরাজ্যের পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, থাইল্যান্ডের সাত বিলিয়ন ডলারের সি-ফুড ইন্ডাস্ট্রি পুরোপুরিভাবে ‘ক্রীতদাস’ নির্ভর। ক্রীতদাসরা ভুতুড়ে জাহাজে চেপে আসেন বাংলাদেশ ও মায়ানমার থেকে।

পত্রিকাটির খবরে আরও বলা হয়, এক একজন মানুষকে সি-ফুড ইন্ডাস্ট্রির মালিকেরা সর্বোচ্চ আড়াইশো পাউন্ডে কিনে নেন।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আলী হোসেন বেনারকে বলেছেন, “প্রশাসন, পুলিশ, র্যাব, কোস্টগার্ড প্রায়ই একসঙ্গে অভিযান পরিচালনা করে থাকে। কখনো কখনো লোকজনকে উদ্ধারও করা যাচ্ছে। কিন্তু  দেশজুড়ে মানুষকে সচেতন করা দরকার।”

কক্সবাজার দিয়ে এরা দেশ ছাড়লেও, আসছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে—এই তথ্য জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, “দালালরা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এক সঙ্গে ২০-২৫ জনকে কক্সবাজার নিয়ে আসেন। প্রশাসন শক্ত অবস্থানে থাকায় তারা এক হোটেল বা বাসায় দুই–তিনজনের বেশি মানুষকে রাখে না।

“মুঠোফোনে যোগাযোগ করে তাদের সাগরের কাছাকাছি নিয়ে এসে মাছ ধরা ট্রলারে তুলে দেওয়া হয়। তা ছাড়া এখন ওই চক্র একই রুট ব্যবহার করছে না,” জানান আলী হোসেন।

এদিকে বাংলাদেশ থেকে থাইল্যান্ডে মানবপাচার রোধ করতে ঢাকার সঙ্গে একটি চুক্তি করতে চায় ব্যাংকক। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, থাইল্যান্ডের সামাজিক উন্নয়ন ও মানব নিরাপত্তামন্ত্রী আদুল সায়েংসিংকেউ সেদেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সাইদা মোনা তাসনিমের সঙ্গে এক সৌজন্য সাক্ষাতের সময় এ কথা বলেন।

থাইল্যান্ডের সঙ্গে তার অন্যান্য প্রতিবেশীদের এ ধরনের চুক্তি থাকার কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, তারা বাংলাদেশের সঙ্গেও এ ধরনের সহযোগিতায় আগ্রহী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।