বাংলাদেশ থেকে মানব পাচার প্রতিরোধ নিয়ে কারও ভাবনা নেই

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.05.18
Thai-trafficking সাগরে ভাসমান ছয় বাংলাদেশী নাগরিককে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে ট্রলারে​ এনে ​১৮ মে বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ানের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৮ মে,২০১৫
বেনার নিউজ

থাইল্যান্ডে বন্দিশালায় এবং সমুদ্রে ভাসমান এ মুহূর্তে কত বাংলাদেশি আছেন, তার পুরো হিসাব সরকারের কাছে কিংবা বাংলাদেশ দূতাবাস, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) বা ইউএনএইচসিআর—কারও কাছে নেই। তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগও দৃশ্যমান নয়।

সরকারের স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় অসহায় নাগরিকদের ফিরিয়ে আনার দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তবে এ বিষয়ে ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে কাজ করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশ সমুদ্র উপকূলে নতুন পাচার বন্ধে অভিযান জোরদার করেছে।

“মানবপাচার নতুন বিষয় নয়। এখন এটা নিয়ে গণমাধ্যমে হইচই হওয়ায় তা সবার নজর কেড়েছে। কিন্তু সরকার মানব পাচারের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে সমুদ্রপথে এভাবে মানবপাচার বা মানবিক বিপর্যয় হতো না,” জানান বেসরকারি অনির্বাণ সারভাইভার ভয়েস নেতা মোহাম্মদ ইলিয়াছ হাওলাদার।

“আমরা শুধু বৈধ অভিবাসন দেখি। অবৈধ অভিবাসনের বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব আমাদের নয়। এটা দেখছে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে, বেনারকে জানান প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী খন্দকার মোশরারফ হোসেন।

তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, থাইল্যান্ডে অবস্থান করা বাংলাদেশিদের বিষয়ে সরকারের নতুন কোনো পদক্ষেপ নেই। তবে থাইল্যান্ড এ বিষয়ে উদ্যোগ নিলে সাড়া দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে সরকারের। অভিবাসী সংকট নিরসনের প্রচেষ্টায় আগামি ২৯ মে থাইল্যান্ডের আঞ্চলিক সম্মেলন আয়োজনের পরিকল্পনাকে স্বাগত জানায় বাংলাদেশ।

এদিকে, আগামি বুধবার কুয়ালালামপুরে মালয়েশিয়া,থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যেখানে মানব পাচার রোধের কৌশল নিয়ে আলোচনা হবে।

গত রোববার মালয়েশিয়া সফররত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী মালয় পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে এক বৈঠকে একই সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন এবং আঞ্চলিক উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।

আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, নতুন করে মানবপাচার আর হচ্ছে না। তবে যারা পাচার হয়েছে তাদের ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব তাদের নয়।


থাইল্যান্ডে অবস্থান করা বাংলাদেশের সাংবাদিক টিপু সুলতান জানান, সাগরপথে মানব পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে অসংখ্য বাংলাদেশি এখন থাইল্যান্ডের বিভিন্ন বন্দিশালায় ধুঁকছেন। কেউ কারাগারে, কেউ অভিবাসন পুলিশের ক্যাম্পে, আবার কেউ বা থানাহাজতে। এঁদের কারও কারাবাসের মেয়াদ দুই দিন, কারও দুই বছর বা তারও বেশি।

“অবস্থা এমন হয়েছে যে সমুদ্র উপকূলবর্তী দক্ষিণ থাইল্যান্ডের দুটি প্রদেশ সংখলা ও পুকেটের কারাগার ও ডিটেনশন ক্যাম্পে আর বন্দীদের জায়গা হচ্ছে না। তাই অনেক বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের দেশটির উত্তরাঞ্চলের চিয়াংরাই প্রদেশসহ কম্বোডিয়ার সীমান্তে স্থাপিত বিভিন্ন ডিটেনশন ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়েছে,” বেনারকে জানান টিপু সুলতান।

বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র জানায়, তাঁদের কাছে ১১ মে পর্যন্ত যে হিসাব আছে, তাতে এ দেশে বন্দী বাংলাদেশির সংখ্যা ৪১৯। সাম্প্রতিক সময়ে যাঁরা আটক হয়েছেন, তাঁদের সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। এমনকি দু-তিন বছর আগে আটক হওয়া অনেকের তথ্য দূতাবাসের কাছে নেই।

দূতাবাসের ওই মুখপাত্র জানান, দূতাবাসের কাউন্সিলর শাখার কর্মকর্তারা গত বছরের মার্চ থেকে এ বছরের ১০ মে পর্যন্ত আটক থাকা ১ হাজার ২১৪ জন বাংলাদেশির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পরিচয় নিশ্চিত হতে। আর গত বছরের ১৩ জুন থেকে ৮ মে পর্যন্ত ৭৯৯ জনকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

সাংবাদিক টিপু সুলতান গত তিন দিনে সংখলা প্রদেশের বিভিন্ন জেলায় তিন ধরনের তিনটি বন্দিশালায় (কারাগার, পুলিশের হাজতখানা ও অভিবাসন) বাংলাদেশি বন্দীদের সঙ্গে অল্প সময় কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন।

“ওদের ভাষা বুঝি না। আমরা বিদেশি বলে লাথি-গুঁতা মারে, ঘৃণা করে। অসুখ হলে চিকিৎসা দেয় না। দুজন মারা গেছে, গ্যাস্ট্রিকের জন্য তারা খেতে পারত না।” ওই সাংবাদিককে জানান সাতক্ষীরার রবিউল হোসেন। তিনি সাদাও জেলা কারাগারে আছেন।

চারদেশীয় সিন্ডিকেট: বহুদিন ধরে বাংলাদেশের উপকূল ব্যবহার করে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় পাচার হচ্ছে বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা। পাচার পথে সাগরে ট্রলার ডুবে মৃত্যুর খবরও আসে প্রায়ই। কিন্তু মানব পাচার প্রতিরোধের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই।

বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া্—এই চার দেশজুড়ে গড়ে উঠেছে মানব পাচার সিন্ডিকেট। তারা এসব দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একটি অংশের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েই ওই চক্রটি কাজ করে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা কারাম এশিয়ার কর্মকর্তা হারুন-উর-রশিদ এক সাক্ষাৎকারে যেমন বলেন, “মেরিটাইম জোন বা সীমান্তে আইন রক্ষাকারী বাহিনীর সমর্থন ছাড়া এমন পাচার সম্ভব নয়। পুরো বিষয়টির সঙ্গেই দুর্নীতি জড়িত।”

ওই কর্মকর্তা বলেন, এত দিন ধরে হাজার হাজার মানুষ পাচারের পেছনে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোন কোন অংশ পাচারকারীদের সহযোগিতা করেছে, তার তদন্তের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখতে বলব সরকারকে।

“এসব মানুষ আজ রাষ্ট্রবিহীন। কিন্তু সরকার বা আন্তর্জাতিক উদ্যোগ সংকটের তুলনায় খুবই কম,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান সোহেল।  

বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ওই নেতা জানান, সরকার দেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করার কথা বলছে, অন্যদিকে কাজ না পেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজের সন্ধানে অবৈধভাবে মানুষ বিদেশ যাচ্ছে। তাদের কাজ দিতে পারছে না, আবার বিদেশে কাজের সুযোগও সৃষ্টি করতে পারছে না।

দুই প্রধানমন্ত্রীকে জাতিসংঘ মহাসচিবের ফোন: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অভিবাসী সংকট নিরসনে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন। ফোনালাপে এ অঞ্চলে উদ্ভূত অভিবাসী সংকট ইস্যুতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।

বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, মুনের সহকারী জান এলিয়াসন বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার মন্ত্রীদের সঙ্গে সংকট নিয়ে আলোচনা করেছেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, “অভিবাসী সংকট নিরসনে সব ধরনের প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত জাতিসংঘ।”

এক বিবৃতিতে বান কি-মুনের মুখপাত্র বলেছেন, অভিবাসীদের প্রাণ রক্ষায় ও আন্তর্জাতিক আইন সমুন্নত রাখতে দেশগুলোর নেতাদের সমুদ্রে উদ্ধার তৎপরতা পরিচালনা ও অভিবাসীদের না ফেরানোর বিষয়ে অনুরোধ করেন মহাসচিব।”

সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড অমানবিকভাবে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের অভিবাসী ও দরিদ্র বাংলাদেশীবোঝাই বোটসমূহকে তীরে ভিড়তে না দিয়ে ব্যাপক সমালোচনা উসকে দেয়।

বান কি-মুন বলেন, “উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তাবিত সম্মেলনসহ (থাইল্যান্ডের প্রস্তাবিত) জাতিসংঘ সব ধরনের প্রচেষ্টায় সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত রয়েছে।”

থাই পুলিশের অভিযান: গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর থেকেই মানবপাচার চক্রের বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযান শুরু করে থাই পুলিশ। সাগর পথে মানবপাচারে জড়িত স্বদেশি চক্রগুলোকে ধরার ব্যাপারে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ১০ দিনের সময়সীমাও গতকাল শেষ হয়েছে। এর মধ্যে চিহ্নিত ৪৫ জন ধরা পড়লেও ১৭ জন পলাতক রয়েছে। এঁদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে, অন্যথায় তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

থাইল্যান্ডের সাতুন প্রদেশের আঞ্চলিক কর্মকর্তা পাজ্জুবান অংকাচোটেফান আত্মসমর্পণ করেছেন। ১৮ মে ওই ব্যক্তি আত্মসমর্পণ করেন বলে থাই পুলিশের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল প্রাউত থাভোর্নসিরির বরাত দিয়ে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম।
থাই মানবপাচার জগতে তাকে ‘সম্রাট (কিংপিন)’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। তিনি দেশটির এক প্রভাবশালী কর্মকর্তা ছিলেন। পাজ্জুবান ‘কো তঙ’ নামেই সর্বাধিক পরিচিত।

গত ১ মে থাইল্যান্ডে পাচারের শিকার বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের গণকবর পাওয়ার পর পাচারবিরোধী বড় অভিযান শুরু করে থাই কর্তৃপক্ষ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।