তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য ময়মনসিংহে প্রথম মসজিদ

অয়ন আমান
2024.04.01
ঢাকা
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য  ময়মনসিংহে প্রথম মসজিদ রাজধানী ঢাকা থেকে ১১৩ কিলোমিটার দূরে ময়মনসিংহ শহরের দক্ষিণ চর কালিবাড়ি এলাকায় হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য গড়া প্রথম মসজিদ। ১ এপ্রিল ২০২৪
[বেনারনিউজ]

দেশে প্রথমবারের মতো স্থাপিত হয়েছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য প্রথম মসজিদ।

বাংলাদেশের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, ভোটাধিকার এবং নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেলেও মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায়ে দ্বিধা করেন, অস্বস্তিতে ভোগেন।

মুসলমানদের জন্য নির্মিত মসজিদে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের নামাজ আদায়ে প্রকাশ্য বিধিনিষেধ না থাকলেও যুগ যুগ ধরে এই পরিস্থিতি চলে আসছে।

এই প্রেক্ষাপটে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা প্রশাসনের সহায়তায় নিজেদের জন্য গড়ে তুলেছেন আলাদা মসজিদ, যা তাদের জন্য দেশের প্রথম মসজিদ বলে বেনারকে জানিয়েছেন হিজড়া জনগোষ্ঠীর অন্যতম প্রতিনিধি ও ময়মনসিংহের গুরুমাতা জয়িতা তনু।

রাজধানী ঢাকা থেকে ১১৩ কিলোমিটার দূরে ময়মনসিংহ শহরের দক্ষিণ চর কালিবাড়ি এলাকায় নির্মিত এই মসজিদে রমজান মাসের শুরু থেকে নিয়মিত নামাজ আদায় করছেন তারা।

এর আগে ২০২০ সালের ৬ নভেম্বর বাংলাদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য প্রথম একটি আলাদা মাদ্রাসা উদ্বোধন করা হয়।  রাজধানী ঢাকার কামরাঙ্গীর চরের লোহার ব্রিজ এলাকায় নির্মিত এই মাদ্রাসাটির নাম রাখা হয় 'দাওয়াতুল কুরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদ্রাসা'

জয়িতা তনু বলেন, “তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সাধারণ মসজিদে নামাজ পড়তে যেতে দৃশ্যমান বাধা না থাকলেও প্রকৃতপক্ষে অদৃশ্য অনেক বাধা আছে।  মৃত্যুর পর তাদের জানাজা দিতে ঝামেলা পোহাতে হয়।  কবরস্থানে মাটি দেওয়া নিয়ে আপত্তি তোলা হয়, যা দুঃখজনক।”

তনু বলেন, “এই এলাকায় একটা সাধারণ মসজিদ ছিল।  আমরা শুরুর দিকে সেখানে নামাজ পড়তাম।  কিন্তু স্থানীয় কিছু মানুষ আমাদের ওই মসজিদে নামাজ পড়তে বাধা দিয়েছিল।”

 

নামাজে অংশ নিচ্ছেন অন্যরাও

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে সমাজের ভুল ধারণা ধীরে ধীরে ভাঙতে থাকায় অন্যেরাও এখন এই মসজিদে নামাজে অংশ নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

“আমরা মুসলিম হিসেবে নামাজ পড়ার জন্য, ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলার জন্য এই মসজিদ প্রতিষ্ঠা করছি।  অনেকেরই এখন ভুল ভাঙতে শুরু করেছে।  তারাও আমাদের সঙ্গে মসজিদে এসে নামাজ পড়ছেন,” বলেন জয়িতা তনু। 

হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য নির্মিত দেশের প্রথম মসজিদের ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন হাফেজ মুহাম্মদ কারীমুল ইসলাম।

তিনি বেনারকে বলেন, “এখন নিয়মিত নামাজ পড়ানো হচ্ছে।  এখানে হিজড়া জনগোষ্ঠীর প্রায় সবাই নামাজ পড়ছেন। স্থানীয় সাধারণ মানুষও মসজিদে নামাজ পড়তে আসছেন।”

ময়মনসিংহ নগরীর ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ চর কালিবাড়ি সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পেয়েছেন ৪০ জন হিজড়া।  ওই এলাকার হিজড়া জনগোষ্ঠীর গুরুমাতা বিভাগীয় কমিশনার উম্মে সালমা তানজিয়ার সঙ্গে দেখা করে মসজিদের জন্য জায়গা চান।

বিভাগীয় কমিশনারের পরামর্শে জেলা প্রশাসক ৩৩ শতক জমি বরাদ্দ দেন।  ওই জমিতে মসজিদ নির্মাণের জন্য ২ লাখ টাকা অনুদানের ব্যবস্থা করে দেন বিভাগীয় কমিশনার।

গত তিন বছরে দেশে হিজড়াদের ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করেছে দাওয়াতুল কোরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদ্রাসা।

অন্তত ৫০ টি জেলায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য মাদ্রাসার কার্যক্রম চলছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মুফতি মুহাম্মদ আবদুর রহমান আজাদ।

তিনি বেনারকে বলেন, “ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের অধিকার হিজড়াদের রয়েছে।  পুরুষ ও নারীর প্রতি যে হুকুম রয়েছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের প্রতি একই হুকুম।  তারা যাতে নামাজ পড়তে পারে, তারাবীহ পড়তে পারে সে জন্যই মসজিদটি তৈরী করা হয়েছে।”

 

যে কারণে পৃথক মসজিদ 

বাংলাদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠী অর্থাৎ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য পৃথক মসজিদ নির্মাণের কারণ তুলে ধরেন হোপ অ্যান্ড পিস ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক নৃত্যশিল্পী রানী চৌধুরী।

রানী চৌধুরী বলেন, "আমাদের অনেকেই সাধারণ মসজিদ ও মাদ্রাসায় যেতে বাধাপ্রাপ্ত হয়।  একজন হিজড়া মারা গেলে আগে তাকে পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হতো।  মাটি দিতে দেওয়া হতো না।  সেজন্য হিজড়ারা যাতে ধর্মীয় শিক্ষা নিতে পারে, সেজন্যই আমরা মসজিদ মাদ্রাসায় তাদের সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছি।”

“আমাদেরও মসজিদ-মাদ্রাসা আছে।  আমাদের বিষয়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে এখন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যাবে না।  এ জন্য আমরা ধর্মীয় শিক্ষায় গুরুত্ব দিচ্ছি,” যোগ করেন তিনি।

চলতি মাসের শুরুতে নির্বাচন কমিশন প্রকাশিত হিসাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে ভোটার সংখ্যা সংখ্যা ১২ কোটি ১৮ লাখ।  এর মধ্যে পুরুষ প্রায় ছয় কোটি ২১ লাখ, নারী প্রায় পাঁচ কোটি ৯৭ লাখ ও হিজড়া ৯৩২ জন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত সর্বশেষ জনশুমারি ও গৃহগণনা, ২০২২ অনুযায়ী দেশে মোট জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। এই হিসাবে দেখানো হয়েছে, দেশে হিজড়ার সংখ্যা ১২ হাজার ৬২৯ জন। তবে সারাদেশে প্রায় দেড় লাখেরও বেশি হিজড়া জনগোষ্ঠীর সদস্য রয়েছে বলে দাবি তাদের।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।

মন্তব্য

মুফতি আবদুর রহমান আজাদ। প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক, দাওয়াতুল কুরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদরাসা (হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের প্রথম মাদরাসা)। মোবা-01710-54-68-67
2024-04-22 22:10

আলহামদুলিল্লাহ, সঠিক সংবাদ পরিবেশনের জন্য বেনার নিউজ-পরিবারকে ধন্যবাদ জানাই।
আমরা প্রত্যেকেই যদি যার যার অবস্থানে থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে হিজড়া, প্রতিবন্ধী ও বেদে সম্প্রদায় সহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেবায় এগিয়ে আসি এবং তাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করি, তাহলে তারা আর সমাজের বোঝা থাকবে না; বরং ইনশাআল্লাহ, অচিরেই তারা মানব-সম্পদে পরিণত হবে এবং দেশকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে।
আর দাওয়াতুল কুরআন এ উদ্দেশ্যেই বিপন্ন মানুষের পাশে থেকে অবিরত কাজ করে যাচ্ছে।
আল্লাহ যেন দাওয়াতুল কুরআনের এই খেদমতকে কিয়ামত পর্যন্ত কবুল করেন এবং তিনিই আমাদের সাহায্যকারী হয়ে যান। আমীন