এক যুগের মধ্যে দুর্নীতিতে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বাংলাদেশের: টিআই

রিয়াদ হোসেন
2024.01.30
ঢাকা
এক যুগের মধ্যে দুর্নীতিতে সবচেয়ে  খারাপ অবস্থা বাংলাদেশের: টিআই ঢাকার ধানমন্ডিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) কার্যালয়ে দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রতিবেদন ২০২৩ প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। ৩০ জানুয়ারি ২০২৪।
[সৌজন্যে: টিআইবি]

দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থানের অবনতি হয়েছে। এবার বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে ১০তম, যা গতবার ছিল ১২তম। শুধু তাই নয়, ২০১২ সালের পর এটিই দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের সবচেয়ে খারাপ অবস্থান।

মঙ্গলবার ঢাকার ধানমন্ডিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে, ২০২৩ সালের দুর্নীতির ধারণাসূচক এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।

প্রতি বছর জার্মানির বার্লিনভিত্তিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বিশ্বের ১৮০টি দেশের ওপর একযোগে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯তম।

বাংলাদেশের এ অবস্থান তুলে ধরে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “দুর্নীতির ধারণাসূচক অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান হতাশাজনক।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের অবস্থানের এই অবনমন (সূচকে) প্রমাণ করে যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন অঙ্গীকার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা বাস্তবিক অর্থে প্রয়োগ হয়নি।”

“আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও কাঠামোগত দুর্বলতায় বাংলাদেশের অবস্থানের আরো অবনতি হয়েছে,” উল্লেখ করে এটিকে তিনি ‘বিব্রতকর’ বলে অভিহিত করেন।

এমন অপবাদ অতীতেও দেওয়া হয়েছে : ওবায়দুল কাদের

টিআইবি’র এমন বক্তব্যের পেছনে রাজনৈতিক স্বার্থ থাকার কথা উল্লেখ করে সরকার তা পরোয়া করে না বলে জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ।

মঙ্গলবার আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “টিআইবি বিএনপির দালাল, বিএনপি যা বলে টিআইবিও তা বলে।”

তিনি বলেন, “আমরা জনস্বার্থে কাজ করে যাচ্ছি। দুর্নীতি বর্তমানে সারা বিশ্বেই আছে, এটা কেবল বাংলাদেশের ব্যাপার নয়।  কিন্তু যেভাবে অপবাদটা বাংলাদেশ নিয়ে দেওয়া হয়, এটা মোটেও সত্য নয়।”

তাঁর মতে, বিশ্বজুড়ে ক্ষমতার যে দ্বন্দ্ব সেখানে অবস্থানগতভাবে কোনো কোনো জোট বা দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের পাহারাদার এসব প্রতিষ্ঠান। 

“এমন অপবাদ অতীতেও দেওয়া হয়েছে।  আমরা এগুলোর পরোয়া করি না,” যোগ করেন তিনি।

দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্কোর ২৪

দুর্নীতির ধারণার মাত্রাকে শূন্য থেকে ১০০-এর স্কেলে নির্ধারণ করা হয়।  ‘শূন্য’ স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এবং ‘১০০’ স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত বলে ধারণা করা হয়।

২০২৩ সালে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্কোর হয়েছে ২৪।  সমান স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একই অবস্থানে রয়েছে আফ্রিকান রিপাবলিক, ইরান, লেবানন ও জিম্বাবুয়ে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, তালিকার দশের মধ্যে থাকা শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত ৩২টি দেশের একটি বাংলাদেশ, বাকি দেশগুলোর বেশিরভাগই আফ্রিকার।

বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী এই সংস্থা ১৯৯৫ সাল থেকে দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রকাশ করে আসছে।

২০০১ সালে প্রথমবারের মত বাংলাদেশকে এই সূচকে অন্তর্ভূক্ত করা হয় এবং ওই বছরই দুর্নীতির শীর্ষে বাংলাদেশের নাম আসে।

পরবর্তী পাঁচ বছর পর্যন্ত একই অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ।  পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় তখন কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছিলো বিএনপি-জামাত জোট সরকার। 

অবশ্য এর পর থেকে ধীরে ধীরে উন্নতি করতে থাকে বাংলাদেশ এবং ২০১৭ সালে এ যাবতকালের সবচেয়ে ভালো বা ১৭তম অবস্থানে যায় বাংলাদেশ।   এরপর থেকে আবার দুর্নীতির ধারণাসূচকে অবনতি হতে থাকে।

প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ ইউরোপের ডেনমার্ক।  এর পর রয়েছে যথাক্রমে ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, সিঙ্গাপুর, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, লুক্সেমবার্গ, কানাডা ও এস্তোনিয়া।

আর সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে সোমালিয়া।   এরপর রয়েছে দক্ষিন সুদান, সিরিয়া, ভেনিজুয়েলা, ইয়েমেন।

রাজনৈতিক প্রভাববলয়ে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করা প্রতিষ্ঠান

টিআইবি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ক্রমেই রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাববলয়ে চলে যাচ্ছে, যা ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতিকে উৎসাহিত করার পেছনে অন্যতম কারন।

মিডিয়া এবং সুশীল সমাজের উপর নিয়ন্ত্রণ এবং ভয় দেখানো; নজরদারি, অসহিষ্ণুতা এবং দুর্নীতির তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রতিশোধ প্রবণতা বাংলাদেশের এই ফলাফলের আরেকটি কারণ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এছাড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহনশীলতার’ বক্তৃতাকে বাস্তবে রূপ দিতে উদ্যোগ দেখা না যাওয়া, সরকারি চুক্তি ও প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাপকভিত্তিক দুর্নীতি, অর্থপাচার রোধে কার্যকর উদ্যোগ না থাকা, ঘুষ ও সরকারি তহবিলের অপব্যবহার, গোষ্ঠীস্বার্থের সুবিধার জন্য সরকারি অফিসকে ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে।

সরকারের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতা

নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থানের কথা বরাবরই বলে আসছে।  গত নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়, “রাষ্ট্র ও সমাজের সকল স্তরে ঘুষ-দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনুপার্জিত আয় রোধ করা, ঋণ-কর-বিল খেলাপি ও দুর্নীতিবাজদের বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে শাস্তি প্রদান এবং তাদের অবৈধ অর্থ ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে।”

এর আগে ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেও দুর্নীতি রোধে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) কর্মপরিবেশ ও দক্ষতার দিক থেকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি ছিলো।

অথচ টিআইবি’র প্রতিবেদনে এসেছে ভিন্ন কথা।

টিআইবি’র প্রতিবেদনের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনকে ফোন করা হলে তিনি মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।

তবে দুদকের সাবেক কমিশনার ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “দুর্নীতি কতটুকু বেড়েছে, তা হয়তো গবেষণা করার বিষয়, তবে দুর্নীতি কমেনি।”

তিনি বলেন, “দুদককে শক্তিশালী করার কথা বলা হলেও বাস্তবে দৃশ্যমান কিছু হয়নি।’

এছাড়া ছোটখাট কিছু মামলায় ভালো করলেও বড় দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, এমন ক্ষেত্রে দুদকের তেমন সাফল্য নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সরকারের উচিত সমাধানে মনযোগ দেওয়া

দুর্নীতিতে বাংলাদেশের পিছিয়ে যাওয়ার মূল কারণ সুশানের অভাব বলে মন্তব্য করেন অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর।

তিনি বলেন , “টিআইবি খারাপ, অন্যদের টাকায় এসব করেছে–এ ধরণের কথা না বলে যে সমস্যাগুলো উঠে এসেছে, সরকারের উচিত তা গুরুত্বের সাথে নিয়ে সমাধানে মনযোগী হওয়া।”

প্রয়োজনে টিআইবি’র সাথে বসে সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করার পরামর্শ দেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে দীর্ঘদিন অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করা ড. মনসুর।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।