তামাকজাত পণ্যের ওপর সারচার্জের টাকা ব্যয় হবে তামাক বিরোধী কাজে
2017.10.24
ঢাকা

প্রতি বছর তামাক ও তামাকজাত পণ্যের ওপর নির্ধারিত সারচার্জ থেকে আসা দুই থেকে আড়াই শ কোটি টাকা এখন থেকে তামাক বিরোধী কাজে ব্যবহার হবে। প্রস্তাবিত স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ পলিসিতে এ কথা বলা হয়েছে।
গত ১৬ অক্টোবর মন্ত্রিসভা নীতিগতভাবে এই পলিসি অনুমোদন করেছে, যা সংবাদ মাধ্যমের কাছে তুলে ধরেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো জাতীয় বাজেটে তামাক ও তামাকজাত পণ্যের ওপর সারচার্জ আরোপ করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও তামাকবিরোধী জোটগুলো বহু বছর ধরে তামাক ও তামাকজাত পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রয়মূল্য বাড়ানোর জন্য আন্দোলন করে আসছিল। সেই ধারাবাহিকতায় সারচার্জ বসানো হয়।
জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়ক রুহুল কুদ্দুস বেনার নিউজকে বলেন, ‘‘এই নীতিমালার অনুমোদন একটি মাইলফলক। এত দিন নীতিমালার অভাবে সারচার্জের টাকা কীভাবে কোন খাতে ব্যয় হবে, সে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছিল না। মন্ত্রিসভার অনুমোদনের ফলে এখন সারচার্জের টাকায় তামাক সেবনের কুফল ও অসংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধের জন্য ব্যাপক প্রচারে নামার সুযোগ তৈরি হয়েছে। প্রতিবছর সারচার্জ থেকে দুই থেকে আড়াই শ কোটি টাকা পাওয়া যাবে।”
তামাক বিরোধী সংস্থাগুলো বলছে, বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির চিত্র ভয়াবহ। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে-২০০৯ অনুসারে বাংলাদেশে ৪ কোটি ১৩ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক সেবন করে। আর পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয় প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪ কোটি ৩০ লাখ মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে মারা যায় ৫৭ হাজার মানুষ এবং পঙ্গুত্ববরণ করে ৩ লাখ ৮২ হাজার জন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর শতকরা ৬০ ভাগ হয় অসংক্রামক রোগের কারণে।
প্রেক্ষাপট
২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেটে প্রথমবারের মতো সকল তামাকজাত পণ্যের ওপর স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আরোপ করা হয়। তামাকজাত দ্রব্য থেকে সারচার্জ আদায় সংক্রান্ত বিধিমালা কার্যকর হয় ২০১৪ সালের ১ জুলাই। এ আইনের আওতায় আমদানি করা এবং দেশে উৎপাদিত সব তামাকজাত পণ্য থেকে ১ শতাংশ হারে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ নেওয়া হচ্ছে।
জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের কর্মকর্তারা বলছেন, এ বছরের জানুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের স্পিকার সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী সারচার্জের টাকা জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে ব্যবহারের ঘোষণা দেন। এরপর থেকেই নীতিমালাটি প্রণয়নের কাজ শুরু হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেবে বাংলাদেশে ৩৯ হাজার ২৩৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়ে থাকে। ২০১৬–১৭ অর্থ বছরে ১৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয় এই খাত থেকে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রাক বাজেট আলোচনায় বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন জানায়, এ বছর তামাক ও তামাকজাত পণ্য থেকে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ হবে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।
জাতীয় কুইট লাইন স্থাপন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশকে তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে সহযোগিতা দিয়ে আসছে। বাংলাদেশে এই সংস্থার ন্যাশনাল প্রফেসর সৈয়দ মাহফুজুল হক বেনারকে বলেন, “কাছের দেশগুলোর মধ্যে থাইল্যান্ড কার্যকরভাবে এই শুল্কের টাকা ব্যয় করছে। বাংলাদেশে অর্থ মন্ত্রণালয় সারচার্জের টাকা তুলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দেবে এবং নীতিমালা অনুযায়ী মন্ত্রণালয় তা ব্যয় করবে।’’
প্রতিবেশী দেশ ভারতে সারচার্জের টাকা বিড়ি শ্রমিকদের উন্নয়নে এবং দুর্যোগ প্রতিরোধে ব্যয় হয়ে থাকে।
তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের কর্মকর্তারা বলছেন, সারচার্জ হিসেবে যে টাকাটা পাওয়া যাবে তা রোগের চিকিৎসায় ব্যয়ের জন্য যথেষ্ট নয়। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী যেহেতু ঘোষণা করেছেন ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে ধূমপানমুক্ত করবেন, সে কারণে শুধু এ খাতেই টাকাটা ব্যয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তাঁদের মতে, তামাকের ক্ষতিকর দিক এবং তামাক নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে গণসচেতনতা বাড়াতে প্রচার চালানোকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। হৃদরোগ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, শ্বাসকষ্টের মতো রোগ প্রতিরোধে মানুষকে সচেতন করতেও এই খাত থেকে পাওয়া টাকা ব্যয় হবে। তামাক চাষিরা যেন তামাকের পরিবর্তে অন্য কিছু চাষে উদ্বুদ্ধ হয় সে জন্য তাদেরও উদ্বুদ্ধ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
তা ছাড়া যারা তামাক সেবন ছাড়তে চান তাদের জন্য একটি জাতীয় কুইট লাইন স্থাপন করা হবে। তামাক সেবন ছাড়ার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও সেবা তাৎক্ষণিকভাবে জাতীয় কুইট লাইনে ফোন করে জানা যাবে।
বন্ধুর পথ
বাংলাদেশে তামাক সেবন ও বিপণন বন্ধে সরকার ও সামাজিক সংগঠনগুলো একসঙ্গে কাজ করছে। তামাক বিরোধী কাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছে প্রজ্ঞা নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
প্রজ্ঞার প্রধান নির্বাহী এবিএম জুবায়ের বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ সরকার ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে ধূমপান মুক্ত করার অঙ্গীকার করেছে। সে লক্ষ্যে সবাই কাজ করছে। তবে তামাক পণ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী সংস্থাগুলো বরাবরই এ কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে আসছে।”
বাংলাদেশে তামাক ও তামাকজাত পণ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে রয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি)। দেশে তামাকের বাজারের দুই –তৃতীয়াংশ এই প্রতিষ্ঠানটির দখলে। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েব সাইট থেকে জানা যাচ্ছে, এর সঙ্গে সরাসির জড়িত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৫০০। তবে মাঠ পর্যায়ে উৎপাদন, কারখানার শ্রমিক ও বাজারজাতকরণে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৫০ হাজার।
সারচার্জ আরোপ ও তামাক নিয়ন্ত্রণে এর ব্যবহারে তাদের কোনো আপত্তি আছে কি না জানতে সোমবার (২৩ অক্টোবর) ইমেইল করা হলেও বিএটিবির কাছ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।