কিশোর বাউলের মাথা ন্যাড়া করায় স্কুল শিক্ষকসহ গ্রেপ্তার ৩
2021.09.22
ঢাকা

বগুড়ার শিবগঞ্জে কট্টর মুসলিম প্রতিবেশীরা কিশোর বাউল মেহেদী হাসানের (১৬) মাথা ন্যাড়া করে দেওয়ার ঘটনায় স্থানীয় পুলিশ মঙ্গলবার রাতে এক স্কুল শিক্ষকসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়েছে।
গত শনিবার রাতে চুল কেটে দেওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় প্রভাবশালীরা বাউল জীবন না ছাড়লে হাসানকে পিটিয়ে গ্রাম ছাড়া করারও হুমকি দেন। ঘটনার দুইদিন পর মঙ্গলবার রাতে পাঁচজনকে আসামি করে শিবগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেন হাসান।
“মঙ্গলবার রাতেই গুজিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গ্রাম্য মাতব্বর মো. মেজবাউল ইসলাম (৫২) এবং তাঁর দুই সহযোগী শফিউল ইসলাম খোকন (৫৫) ও তারেক রহমানকে (২০) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ,” বেনারকে বলেন শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম।
অন্য দুই পলাতক আসামি ফজলু মিয়া (৪০) ও আবু তাহেরকে (৫৫) ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
মামলার অভিযোগে হাসান জানিয়েছেন, তিনি বাউল শিল্পী মতিয়ার রহমান মতিনের (৫৫) শিষ্য। গুরুকে অনুসরণ করে বড়ো চুল রাখার পাশাপাশি পোশাক হিসেবে সাদা গামছা, ফতুয়া ও লুঙ্গি ব্যবহার করেন তিনি।
অভিযুক্তরা প্রায়ই তাঁর গান, পোশাক ও গুরুকে নিয়ে বাজে কথা বলতেন, বিভিন্ন সময় তিনি এর প্রতিবাদও করেছেন জানিয়ে হাসান এজাহারে বলেন, তাঁরাই ক্ষিপ্ত হয়ে শনিবারের ঘটনাটি ঘটায়। চুল কাটতে বাধা দেওয়ায় তাঁকে মারধরও করা হয়েছে।
“এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আবহমান বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতির ওপর ধর্মান্ধদের আঘাতেরই অংশ,” জানিয়ে ওসি বেনারকে বলেন, “বাউল গান গাওয়া কোনো অপরাধ নয়। চুল রাখা বা সাদা পোশাক পরার জন্য কাউকে অপমান ও মারধর করে ন্যাড়া করে দেওয়া অবশ্যই অপরাধ।”
“এই ঘটনায় জড়িতরা কোনো ইসলামি সংগঠনের সাথে জড়িত নয় বলেই আমরা জানতে পেরেছি। তাঁরা মূলত অতি উৎসাহী,” যোগ করেন তিনি।
মামলা করার পর হাসান আর বাড়িতে ফেরেননি বলে বুধবার রাতে বেনারকে জানান তাঁর বাবা মো. বেলাল মণ্ডল (৪০)। হাসান তার নিজের সিদ্ধান্তেই চলেন বলে জানান তিনি।
এদিকে অভিযুক্তরা সবাই শিক্ষিত ও ধার্মিক উল্লেখ করে শিবগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোফায়েল আহম্মদ সাবু বেনারকে জানান, বাউল কিশোরটি প্রতি সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বালিয়ে যে আচার পালন করতেন তার সাথে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজার সাদৃশ্য থাকায় ক্ষিপ্ত ছিলেন স্থানীয় ওই মুসলিমরা।
“এমন ঘটনা একদমই অনাকাঙ্ক্ষিত। তারা (অভিযুক্তরা) ছেলেটির অভিভাবকদের বা আমাকে জানাতে পারতেন। সেটা না করে তারা যেটা করেছেন সেটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশ জাতীয় বাউল সমিতি ফাউন্ডেশনের সাবেক সভাপতি কাজল দেওয়ান বেনারকে বলেন, “এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। তবে দেশে অহরহই এমনটা ঘটছে। বাউলদের অধিকাংশই প্রত্যন্ত এলাকায় থাকেন। তাই অধিকাংশ ঘটনাই জানা যায় না।”
“এ ব্যাপারে সবার সোচ্চার হওয়া দরকার। বিশেষ করে প্রশাসনের আরো অনেক বেশি খেয়াল রাখা উচিত,” বলেন তিনি।

কমেছে আয়, থামেনি পীড়ন
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সাধুসঙ্গ বা ওরসের মতো আয়োজনগুলো কমে যাওয়ায় অনেক নামিদামি বাউল শিল্পীরাও বর্তমানে খুবই অভাব-অনটনে আছেন বলে বেনারকে বলেন বাংলাদেশ বাউল সমিতির সভাপতি ছোবহান সরকার।
“প্রতি বছর দেশে-বিদেশে কমপক্ষে আড়াইশো অনুষ্ঠানে গান গাইতাম। কিন্তু গত বছরের মার্চে বাংলাদেশে করোনা ধরা পড়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ৪০-৪৫টি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি,” বেনারকে জানান জনপ্রিয় শিল্পী কাজল দেওয়ান।
এই অবস্থার মধ্যেও উগ্রবাদীদের চাপে বাউল, ফকির, সাধুসহ লোকসংস্কৃতির অনুসারীদের সঙ্কট ক্রমাগত বাড়ছে বলে জানান বাউল নেতারা।
‘বাউলরা শুধু মার খায়’
গত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় বাউলদের গানগুলো ফেসবুক, ইউটিউবের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলোয় ছড়িয়ে পড়ায় নতুন ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে জানিয়ে ছোবহান বলেন, এ কারণে তাঁরা এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়েও শঙ্কিত।
গত বছর বিতর্কিত ওই আইনের মামলায় টাঙ্গাইলের বাউল রিতা দেওয়ানকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়, শরীয়ত বয়াতিকে জেলে যেতে হয়।
এর পাশাপাশি “শারীরিক নির্যাতন, একঘরে করে দেওয়া, হুমকি-ধামকি এসবই বাউলদের নিত্যসঙ্গী,” যোগ করেন ছোবহান।
সাম্প্রতিক আফগানিস্তান পরিস্থিতি কট্টর মুসলিমদের নতুন করে উসকে দিয়েছে দাবি করে কাজল দেওয়ান বলেন, “আমাদের দেশের তালেবান বা আল-কায়েদাপন্থীরা সব সময় ঘাপটি মেরে থাকে।” তাঁর বাবা ‘মাতাল কবি’ খ্যাত রাজ্জাক দেওয়ানের ওরস আয়োজন করতে গিয়ে প্রতি বছরই মোল্লাদের বাধার সম্মুখীন হওয়ার কথা জানান তিনি।
গণমাধ্যমে আসেনি এমন অন্তত ছয়টি বাউল পীড়নের খবর গত কয়েক মাসে পেয়েছেন বলে জানান ছোবহান সরকার।
“নির্বিবাদী মানুষ হওয়ার কারণে বাউলরা শুধু মার খায়, কখনো মার দেয় না। সংগঠিত হয়ে জোরালো কোনো প্রতিবাদও করতে পারে না। যে কারণে আমাদের পরিস্থিতিরও কোনো উন্নতি হচ্ছে না,” বলেন ছোবহান সরকার।
এর আগে ২০১১ সালে রাজবাড়ির পাংশায় ২৮ জন বাউলের চুল দাড়ি কেটে জোর করে তওবা পড়ানো হয়েছিল।
২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশে অন্তত ১৪ জন সুফি মতাদর্শীকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে, যেগুলোর প্রতিটিতেই স্থানীয় জঙ্গি সংগঠনগুলোকে পুলিশ দায়ী করেছে বলে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে এক প্রতিবেদনে জানায় ব্রিটিশ গণমাধ্যম ডেইলি মেইল।
বিগত দশকের বিভিন্ন বছরে বেশ কিছু বাউল পীড়ন ও মতাদর্শিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আলোচিত হয়েছিল। যার মধ্যে ২০১৬ সালের জুলাইতে চুয়াডাঙ্গায় বাউলদের একটি আখড়ায় আগুন দিয়ে দুই বাউলকে মারধর করে চুল কেটে দেয় দুর্বৃত্তরা। একই মাসে জেলার অন্য একটি আখড়ায় হামলা চালিয়ে তিন বাউলকে কুপিয়ে জখম করা হয়।
ওই বছরের অক্টোবরে ফরিদপুরে বাউলদের একটি আখড়াও আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, নভেম্বরে নেত্রকোনার কেন্দুয়ার কট্টর মুসুল্লিরা বাউলরা অনৈসলামিক কাজ করার অভিযোগ তুললে লালন ভক্তদের বার্ষিক আয়োজন বন্ধ করে দেয় পুলিশ।
একই বছরের মে মাসে কুষ্টিয়ায় বাউল সাধক মীর সানাউর রহমানকে কুপিয়ে হত্যার দায় স্বীকার করে আইএস (ইসলামিক স্টেট)। সেই মাসেই রাজশাহীর তানোরে মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ নামের এক সুফি সাধককে হত্যা করা হয়।
তার আগের মাসে একই কায়দায় খুন হন চলচ্চিত্র ও সংগীত-প্রেমী হিসেবে পরিচিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম। ২০১৪ সালের নভেম্বরে প্রকাশ্য সড়কে খুন হওয়া একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফিউল ইসলামও লালন ভক্ত ছিলেন।
২০১৫ সালের অক্টোবরে ঢাকায় মধ্য বাড্ডার নিজ বাসায় সুফিবাদী পীর, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ খিজির খানকে জবাই করে হত্যা করা হয়। তার আগের মাসে চট্টগ্রাম নগরের আকবর টিলা এলাকায় ‘ল্যাংটা ফকিরের মাজারে’ রহমতউল্লাহ ওরফে ল্যাংটা ফকির ও তার খাদেম আবদুল কাদেরকে জবাই করা হয়।
উল্লেখ্য, ইউনেস্কো ২০০৫ সালে বাউল সংগীতকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ইতোমধ্যে তাদের উদ্যোগ ও সহযোগিতায় বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা বাউল গানের বিশাল ভাণ্ডার থেকে প্রায় পাঁচশো গান সংগ্রহ করে সংকলিত করা হয়েছে, যেখানে শতাধিক গানের ইংরেজি অনুবাদ ও ১৫০টি গানের স্বরলিপি যুক্ত করা হয়েছে।