মূসক আইন নিয়ে মুখোমুখি সরকার ও ব্যবসায়ীরা
2017.05.02
ঢাকা

জাতীয় বাজেট সামনে রেখে নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও সম্পূরক শুল্ক আইন-২০১২ বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে বড় ধরনের টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। ২০১২ সালে প্রণীত হলেও ব্যবসায়ীদের বাধার কারণে এতদিন সরকার তা প্রয়োগ করতে পারেনি।
আইনটির বাস্তবায়ন ঠেকাতে অনেক দিন থেকেই দেনদরবার করছিলেন ব্যবসায়ীরা। সরকার আইনটির বাস্তবায়ন শুরু করায় ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাঁরা আন্দোলন করবেন। জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, পুলিশ দিয়ে আন্দোলন দমন করা হবে।
গত রবিবার বাজেট বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির বার্ষিক সভায় বিষয়টি নিয়ে দুই পক্ষের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয় এবং অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটে। ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ওই সভায় অর্থমন্ত্রী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদসহ শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এই পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “ভ্যাট অ্যাডভান্স অ্যাণ্ড প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্স। আজ হোক আর কাল হোক ওই জায়গায় আমাদের যেতে হবে। একটি নির্দিষ্ট অংকের ওপর গেলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে।”
ওই অর্থনীতিবিদের মতে, আইনটি বাস্তবায়নের বড় সমস্যা হচ্ছে, প্রস্তুতিতে ঘাটতি। দেশে ইলেকট্রনিক রেজিস্ট্রার পদ্ধতি নেই, হিসাব পদ্ধতিও আধুনিক নয়। এগুলো নিশ্চিত না করে আইনটি কার্যকর করা কঠিন। তিনি মনে করেন, ধীরেসুস্থে আইনটির প্রয়োগ করা উচিত। এ জন্য আরেকটু সময় নেওয়া যেতে পারে। তা ছাড়া ১৫ শতাংশের পরিবর্তে মূসক ১২ শতাংশ হতে পারে।
কী আছে নতুন আইনে?
নতুন আইনে ছোটবড় সব ধরনের ব্যবসা ও সেবার ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ মূসক আরোপের কথা বলা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের মূল আপত্তি এখানেই। যদিও বার্ষিক টার্নওভার বছরে ৩০ লাখ টাকার নিচে হলে মূসক দিতে হবে না।
নতুন ব্যবস্থায় আমদানি, উৎপাদন ও সরবরাহের সকল স্তরে মূসক প্রযোজ্য হবে। এ জন্য উৎপাদনকারী ও সেবাদানকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিম্ন পর্যায়ের যথাযথ হিসাব রাখার ব্যবস্থা করা হবে।
ব্যবসায়ীরা আগের মতো এলাকা ও ব্যবসার ধরন অনুযায়ী এনবিআরের ঠিক করে দেওয়া নির্দিষ্ট হারের ‘প্যাকেজ মূসক’ চালু রাখার পক্ষে। বর্তমানে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় প্যাকেজ ভ্যাটের পরিমাণ সর্বোচ্চ ১৪ হাজার টাকা।
একটি পণ্য ক্রেতার হাতে পৌঁছাতে কমপক্ষে তিনটি ধাপ পার হতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “এতে আমদানি বা উৎপাদন, পরিবেশক ও খুচরা পর্যায়ে ১৫ শতাংশ করে—তিন পর্যায়ে মোট মূসক দাঁড়াবে ৪৫ শতাংশ। এটা বড় চাপ।”
আমদানি, উৎপাদন, সরবরাহ ও বিক্রি পর্যায়ে মূসকের হার ৭ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে রাখার পক্ষে ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া মূসক নিবন্ধন পদ্ধতি এবং বার্ষিক টার্নওভার অনুযায়ী করসীমা নিয়েও তাঁদের আপত্তি রয়েছে।
এফবিসিসিআই সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদ বেনারকে বলেন, “ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী নতুন মূসক আইন সংশোধন করা না হলে এর বাস্তবায়ন কঠিন হবে।”
তিনি ৩০ লাখ টাকার পরিবর্তে ৩৬ লাখ টাকা পর্যন্ত টার্নওভার করমুক্ত করার দাবি জানান।
আইনের কিছু ধারা নিয়ে আপত্তি
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আবুল কাশেম খান বেনারকে বলেন, “আইনের ৮৩তম পরিচ্ছেদে কোনো ব্যক্তির বাড়িতে, গাড়িতে ও অফিসে গিয়ে তাঁর নথিপত্র ও ব্যাংক হিসাব অনুসন্ধানের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এটা মানবাধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতা-বহির্ভূত।”
তিনি বলেন, “নতুন আইনে মূসক ফাঁকি দেওয়া, দিতে দেরি করা অথবা দৃশ্যমান জায়গায় হিসাব ঝোলানো না হলে প্রতিটির জন্যই ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা দেওয়ার কথা। এমনকি ব্যবসায়ীদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে রাজস্ব কর্মকর্তাকে। এতে ব্যবসায়ীদের ওপর হয়রানি বাড়বে।”
অনড় সরকার
দাবিগুলো নিয়ে ব্যবসায়ীরা গত দুই মাসে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করলেও সরকারের অবস্থানের নড়চড় হয়নি। আগামী জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে নতুন আইন কার্যকর করা হবে। গত অর্থ বছরের (২০১৬-১৭) বাজেট পেশকালেই এই ঘোষণা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী।
আইনটি বাতিলের দাবিতে গত বছরের ৩০ মে এক ঘণ্টা দোকান বন্ধ রেখে রাস্তায় নেমে মানববন্ধন করেন ব্যবসায়ীরা।
নতুন উত্তাপ
ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব না মানলে আন্দোলনে নামার হুমকি দেন এফবিসিসিআই পরিচালক আবু মোতালেব।
সেদিনের সভায় তিনি বলেন, “আমাদের স্কুলছাত্রদের মতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে আন্দোলন করতে বাধ্য করবেন না।”
এ সময় অর্থমন্ত্রী তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজের মাইক অন করে বলেন, “দেশে আট লাখ নিবন্ধিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকলেও মূসক দেয় মাত্র ৩২ হাজার। আপনারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা কতজন মূসক দেন!”
এসময় ব্যবসায়ীদের আন্দোলন দমনের হুশিয়ারি দেন তিনি।
অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর উপস্থিত ব্যবসায়ী নেতারা উচ্চকন্ঠে প্রতিবাদ শুরু করেন। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘আন্দোলন দমনের হুমকি দেবেন না।”
এনবিআর এর বিবৃতি
ব্যবসায়ীদের আন্দোলনের হুমকির প্রেক্ষাপটে রোববার সংবাদমাধ্যমে একটি বিবৃতি পাঠায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড—এনবিআর। বিবৃতিতে যারা ‘জনগণের প্রদত্ত অর্থ আত্মসাতের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য অপপ্রচার চালাচ্ছেন’—তাদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
এনবিআর জানায়, “বাংলাদেশের জনগণ এখনও ১৫ শতাংশ হারে মূসক দিচ্ছে। আদায় করা সেই কর যেন ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেন, নতুন আইন তা নিশ্চিত ও সহজ করবে।”
বোর্ড বলেছে, “জনগণ তাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে মূসক দেয়। যারা মূসক আদায় করেন, অথচ ভোক্তাকে চালান দিতে চান না, তাদের প্রশ্রয় না দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে।”