মানবপাচারের দায়ে যুক্তরাষ্ট্রে এক বাংলাদেশির কারাদণ্ড
2021.01.07
ঢাকা

মানবপাচারে যুক্ত থাকার দায়ে মোক্তার হোসেন নামে এক বাংলাদেশিকে বৃহস্পতিবার কারাদণ্ড দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের এক আদালত।
মোক্তারকে (৩২) মেক্সিকো থেকে টেক্সাস সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশিদের যুক্তরাষ্ট্রে পাচারে যুক্ত থাকার দায়ে ৪৬ মাসের এই সাজা দেয়া হয় বলে এক বিবৃতিতে জানায় দেশটির ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস।
কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষে মোক্তার আরো তিন বছর পর্যবেক্ষণে থাকবেন বলেও এতে জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, মোক্তার ২০১৭ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশিদের যুক্তরাষ্ট্রে পাচারের কথা স্বীকার করেছেন।
মোক্তার মেক্সিকোর মন্টেরির বাসিন্দা ছিলেন। তিনি সেখান থেকে কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর আগে সেখানে এনে জড়ো করতেন।
এছাড়া তিনি অভিবাসীদের কীভাবে রিও গ্রান্ডি নদী পার করে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করানো হবে সে বিষয়েও গাড়ি চালকদের নির্দেশনা দিতেন।
মোক্তারকে ২০১৮ সালের ২৯ নভেম্বর মেক্সিকো থেকে যুক্তরাষ্ট্র অবতরণের পর টেক্সাসের জর্জ বুশ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
জিজ্ঞাসাবাদে মোক্তার মোট ১৪ জন বাংলাদেশিকে যুক্তরাষ্ট্রে পাচারের কথা স্বীকার করেন বলে সে সময় জানায় ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস।
পরবর্তীতে ২০১৯ সালের আগস্টে মোক্তারকে দোষী সাব্যস্ত করে টেক্সাসের একটি আদালত। যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ম অনুযায়ী আদালতে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার পরবর্তী সময়ে দণ্ডের মেয়াদ ঘোষণা করা হয়।
মোক্তারের ক্ষেত্রে যা ঘোষণা করা হলো বৃহস্পতিবার।

ঢাকা মানবপাচার চক্রের চার সদস্য গ্রেপ্তার
আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের চার বাংলাদেশি সদস্যকে আটক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপে সক্রিয় ওই সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রটির মূল শিকার ইউরোপ যাত্রায় আগ্রহীরা।
বৃহস্পতিবার সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন ডেকে এসব তথ্য জানান সিআইডির অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) শেখ ওমর ফারুক।
তিনি জানান, বেশ কিছু বাংলাদেশি ভুক্তভোগীকে প্রথমে ভ্রমণ ভিসায় স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের হায়দ্রাবাদে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আটকে রেখে ইউরোপের ভিসা দেওয়ার কথা বলে স্বজনদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে পাচারকারীরা। কেউ টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে তাঁকে নির্যাতন করা হয়েছে। পরে ভারতীয় দালালরা তাঁদের শ্রীলঙ্কার গহীন জঙ্গলে ফেলে রেখে পালিয়েছে।
সেই জঙ্গল থেকে সম্প্রতি দেশে ফিরে আসা যুবক আহসান হাবীবের অভিযোগের সূত্র ধরেই এই চারজনকে বুধবার ঢাকার উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান শেখ ওমর ফারুক।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন মো. হাবিবুর রহমান, মামুনুর রশিদ মামুন, মো. জামাল হোসেন ও নাহিদুল ইসলাম পলাশ।
সিআইডির জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার জিসানুল হক বেনারকে জানান, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে হাজির করে চারজনেরই রিমান্ড চায় পুলিশ। আদালত শুধু হাবিবের এক দিন ও মামুনের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে।
টাকা আদায়ের পর জঙ্গলে ফেলে দেয়
সিআইডি জানায়, মাল্টা, চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি, মিশর ও কম্বোডিয়া, এমনকি মালদ্বীপে চাকরি দেওয়ার কথা বলেও লোক সংগ্রহ করত এই চক্রটি। ভারতের হায়দ্রাবাদে নিয়ে একটি সুউচ্চ ভবনে মোট ১৯ বাংলাদেশিকে আটকে রাখা হয়েছিল।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ভুক্তভোগী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আহসান হাবীব জানান, মাল্টা পাঠানোর কথা বলে তাঁর সঙ্গে ১২ লাখ টাকার চুক্তি করে উল্লেখিত চক্রের এক সদস্য। আট লাখ টাকা দিয়ে ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করেন তিনি।
“দালালরা বলেছিল চাকরিতে যোগদানের পর বাকি চার লাখ টাকা নেবে। কিন্তু ভারতের হায়দ্রাবাদে নিয়ে নির্যাতন করে বাকি চার লাখ টাকা আদায় করে। এরপর আমাকেসহ আরও ১৯ জনকে ট্রলারে করে শ্রীলঙ্কার একটি দ্বীপে নিয়ে গিয়ে জঙ্গলে ফেলে দেয়,” বলেন তিনি।
পরে আহসান সেখান থেকে পালিয়ে স্থানীয় এক শ্রীলঙ্কানের সহায়তায় পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে দেশ থেকে বিমান ভাড়ার টাকা নিয়ে ফিরে আসতে সক্ষম হন।
অতিরিক্ত ডিআইজি ফারুক বলেন, “এই চক্রটি ছয় থেকে সাত বছর ধরে এ কাজে জড়িত। তারা এ পর্যন্ত কমপক্ষে একশ লোক পাচার করেছে। তবে এখন পর্যন্ত আমরা সব ‘ভিকটিমের’ সন্ধান পাইনি। এ বিষয়ে আমাদের তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।”
“চক্রটিতে বিভিন্ন দেশের সদস্যরা কাজ করছে বলে প্রাথমিকভাবে আমরা জানতে পেরেছি,” জানিয়ে তিনি বলেন, “ভারত, শ্রীলঙ্কা বা মালদ্বীপ হয়ে ইউরোপে যাওয়ার কথা বলে প্রলোভন দেখায় এই চক্রের দালালরা।”
শ্রীলঙ্কার জঙ্গলে বাংলাদেশিদের ফেলে আসার ঘটনা আগে কখনো শোনা যায়নি উল্লেখ করে অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীর বেনারকে বলেন, “এক্ষেত্রে গভীর অনুসন্ধান দরকার।”
তিনি বলেন, “এমনও হতে পারে, আরও আগে থেকে এটা শুরু হয়েছে বা চলে আসছে।”
ইউরোপ যাত্রা থামছে না
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) ওয়েবসাইটের দেখা গেছে, ২০২০ সালে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে বা স্থলপথে যত মানুষ অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশ করেছে, সেই তালিকায় বাংলাদেশিরা চতুর্থ। গত নভেম্বর পর্যন্ত চার হাজার ৪০২ জন সেখানে পৌঁছেছে।
“এসব পরিসংখ্যানই বলে দেয় অবৈধপথে ইউরোপে প্রবেশের একটি সাফল্যের হার তৈরি হচ্ছে। যা পাচারকারী চক্রের দালালদের শিকার ধরতে সহায়তা করছে। এটা কোনো দেশের সরকারই একা বন্ধ করতে পারবে না। এ জন্য আন্তর্জাতিকভাবে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন,” বলেন আসিফ মুনীর।
ইউরোপে যাওয়ার পথে গত বছরের মে মাসে লিবিয়ার মিজদা অঞ্চলে মানবপাচারকারীদের কাছ থেকে অপহরণের শিকার হন ৩৮ জন বাংলাদেশি। পরে তাঁদের গুলিতে ২৬ বাংলাদেশি নিহত এবং বাকি ১১ জন আহত হন।
এর আগে ২০১৯ সালের মে মাসে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া ইতালিগামী নৌকাডুবির ঘটনায় কমপক্ষে ৪০ বাংলাদেশি নিখোঁজ এবং ১৪ জন জীবিত উদ্ধার হয়েছিলেন। জুন মাসে আরেকটি বিকল নৌকা থেকে তিন সপ্তাহ ধরে তিউনিসিয়ার জলসীমায় ভেসে বেড়ানো ৬৪ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু)‘বাংলাদেশ থেকে শ্রম অভিবাসনের গতি প্রকৃতি ২০১৯’ শীর্ষক এক প্রকাশনায় বলা হয়েছে, একটি সংগঠিত মানবপাচারকারী চক্র বাংলাদেশিদের ভারত, দুবাই, তুরস্ক, লিবিয়া হয়ে তিউনিসিয়ার উপকূল দিয়ে নৌকায় করে ইতালি পাঠিয়ে থাকে।