যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদন: মানবপাচার বন্ধে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিলেও তা নির্মূল হয়নি
2021.07.02
ঢাকা

মানবপাচার বন্ধে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিলেও তা নির্মূলে নূন্যতম মান রক্ষা করেনি বাংলাদেশ। ২০২১ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচার সংক্রান্ত ‘ট্রাফিকিং ইন পারসন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই মত দেয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ থেকে মানবপাচার বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, মানবপাচার কমেছে। তবে দালালের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়া একটা ‘বড়ো সমস্যা’ বলে স্বীকার করেন তিনি।
শুক্রবার প্রকাশিত মার্কিন প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবপাচার নির্মূলের ব্যাপারে নূন্যতম মান রক্ষা না করলেও মানবপাচার বন্ধ করতে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে। এর প্রেক্ষিতে করোনাভাইরাস মহামারির পরিস্থিতি বিবেচনায় পূর্বের মতো এ বছরও মার্কিন মূল্যায়নে দ্বিতীয় ধাপেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবপাচার বন্ধে বাংলাদেশের বাড়তি পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে, মানবপাচারকারীদের বিচারে বাড়তি ব্যবস্থা গ্রহণ, বিশেষ ট্রাইবুনালে মানবপাচার মামলা নিষ্পত্তি এবং মানবপাচার সংক্রান্ত অপরাধ নির্মূলে বিদেশি সরকারের সাথে সহায়তা করা।
এছাড়া বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের দায়ে কুয়েতে দণ্ডিত এক সংসদ-সদস্যের সদস্যপদ খারিজ করার কথাও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
তবে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সরকার নূন্যতম মান রক্ষা করেনি। যেমন, মানবপাচার সংক্রান্ত মামলায় সাজার হার কমেছে গত বছর।
এছাড়া মানবপাচারের সাথে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা ও যৌন পল্লিতে রোহিঙ্গা নারী ও শিশু পাচার ইত্যাদির ব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্য ঘটনাগুলোও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অস্বীকার করে চলেছে বলে অভিযোগ করা হয় প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে বিদেশে জনশক্তি পাঠানোর ক্ষেত্রে বেশি অর্থ নেয়ার অনুমতি দিয়েছে সরকার এবং অবৈধ সাব এজেন্টদের কর্মকাণ্ড বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
মানবপাচার কমেছে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
চলতি বছরের মার্কিন প্রতিবেদনটি না দেখলেও প্রতিবেদনে কী বলা হয়েছে তা শুনেছেন জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “কোনোভাবেই আমরা মানবপাচারকে সমর্থন করি না। আমরা এই জঘন্য অপরাধ দমনের জন্য ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছি।”
“যারা বিদেশে কাজের জন্য যেতে চান তাঁরা বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বৈধ পথে যান। অন্য কোনোভাবে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ নেই,” মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, “তবে কিছু কিছু বাংলাদেশি লোভে পড়ে দালালদের মাধ্যমে অনেক টাকা পয়সা দিয়ে বিদেশে যায়। এরা বিভিন্ন স্থানে ধরা পড়ার পর আমরা জানতে পারি।”
তিনি বলেন, “এই দালাল চক্রকে ঠেকাতে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। কোনো অভিযোগ পেলেই দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়।”
“তবে, বর্তমানে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো রোহিঙ্গারা। এরা উন্নত জীবনের আশায় দালালের প্রলোভনে পড়ে যে যেভাবে পারে বিদেশে চলে যায়,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তাঁর মতে, বাংলাদেশে কড়াকড়ি থাকায় “রোহিঙ্গারা পালিয়ে প্রথমে মিয়ানমার যায়। সেখান থেকে দালালের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।”
রোহিঙ্গাদের মানবপাচারের শিকার হওয়া থেকে সুরক্ষা দিতে শরণার্থী শিবিরের চারপাশে কাঁটাতারে বেড়া নির্মাণ করা হয়েছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “সীমান্ত নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ফলে আমি বলব মানবপাচার কমে এসেছে।”
“মানবপাচার কমে আসার আরেকটি বড়ো কারণ হলো দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকেই এখন আর বিদেশ যেতে চান না,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
‘ভিয়েতনাম ফেরতরা পাচারের শিকার নন’
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো গত বছর ভিয়েতনাম থেকে মানবপাচারের শিকার একশ’র বেশি বাংলাদেশিকে ফেরত এনেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, তবে তাঁরা পাচারের শিকার কি না তা বিবেচনা না করে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার মতো অস্পষ্ট অভিযোগ সরকার তাঁদের কারাগারে পাঠায়।
গত বছর আগস্টে কয়েক দফায় বাংলাদেশ থেকে কমপক্ষে ১০৬ জন ভিয়েতনামে গিয়ে আটকা পড়েন। তাঁরা জানিয়েছেন, তাঁদেরকে মালয়েশিয়ার নেবার কথা বলে ভিয়েতনামে ফেলে যায় দালালরা।
প্রায় মাস খানেক সেখানে অবস্থানের পর বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে করে তাঁদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। পাচারের শিকার ব্যক্তিরা হ্যানয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে অবস্থান করে প্রতিবাদ জানান।
সেপ্টেম্বরে দেশে ফেরার পর তাঁদের সন্দেহজনক ৫৪ ধারায় আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়।
ভিয়েতনাম থেকে ফেরা ওই ব্যক্তিদের ব্র্যাকের নেতৃত্বে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা আইনি সহায়তা দেয় বলে শুক্রবার বেনারকে জানান ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান।
তিনি জানান, বিনা অভিযোগে ভিয়েতনাম ফেরত ব্যক্তিরা তিন থেকে পাঁচ মাস কারাগারে থাকার পর বর্তমানে সকলেই উচ্চ আদালতের নির্দেশে জামিনে রয়েছেন।
তবে “ওই ১০৬ জন বাংলাদেশি কোনোভাবেই পাচারের শিকার নয়,” বলে শুক্রবার বেনারের কাছে দাবি করেন ভিয়েতনামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ।
ওই ব্যক্তিরা “পূর্বপরিকল্পিত উপায়ে ভিয়েতনামে এসে বাংলাদেশ দূতাবাসে অবস্থান নেয় এবং দূতাবাস ভাঙচুর করে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “এরা বিদেশে বাংলাদেশ সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে এই কাজ করেছে।”
তিনি বলেন, “তাদের দাবি বিনা পয়সার তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু আমাদের এমন কোনো তহবিল নেই। তারা দূতাবাসে ঢুকে ভাঙচুর করছিল এবং সেগুলো ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচার করেছিল।”
“একজন পাচারের শিকার মানুষ নিঃসন্দেহে এই ধরনের কাজ করার কথা নয়,” বলেন সামিনা নাজ।
মানবপাচার বন্ধে ‘দৃশ্যমান পদক্ষেপ’ নেই
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খানের মতে, মানবপাচার বন্ধে বাংলাদেশে এমন কোনো “দৃশ্যমান পদক্ষেপ” নেয়া হয়নি যার কারণে মনে হবে যে “সরকার মানবপাচার বন্ধে সিরিয়াস।”
“বরং উল্টো চিত্র দেখা গেছে। সরকারি সংস্থার কিছু কিছু মানুষ মানবপাচার চক্রের সাথে জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে,” বেনারকে বলেন নূর খান।
উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরোর এক নারী কর্মচারী মানবপাচারের সাথে জড়িত বলে আমরা সংবাদ দেখেছি।
তিনি বলেন, এছাড়া মানবপাচারের দায়ে একজন সাংসদের সংসদ-সদস্য পদ বাতিল হলেও “তাঁর ব্যাপারে জানা গেছে বিদেশি সরকারের কারণে। আমাদের দেশীয় কোনো সংস্থা মানবপাচারের সাথে তাঁর এই সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়নি।”
“বাংলাদেশ থেকে মানবপাচার হচ্ছে—এটা সত্য। আমরা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সুবাদে জানতে পারি, বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বের বিভিন্নস্থানে যেমন তিউনিশিয়া, বসনিয়ার জঙ্গলে, লিবিয়া, ভিয়েতনাম ও অন্যান্য দেশের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে,” বলেন নূর খান।
তাঁর মতে, মানবপাচারকারী দালালচক্রের সাথে “সরকারি সংস্থার কর্মকর্তাদের যোগাসাজস না থাকলে,” তাঁরা কোনোভাবেই তাঁদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবার কথা নয়।
“সুতরাং, বাংলাদেশ থেকে মানবপাচার চলছে। কোনো অবস্থাতেই মার্কিন মানবপাচার সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব নয়,” বলেন তিনি।
শুক্রবার প্রকাশিত ৬০০ পৃষ্ঠার বেশি ওই মার্কিন প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৮৮টি দেশের মানবপাচার পরিস্থিতির মূল্যায়ন করা হয়েছে। বর্তমানে বৈশ্বিকভাবে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ মানবপাচারের শিকার বলে প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে জানান যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন।