হিজড়া পরিচয়েই উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া যাবে

আহম্মদ ফয়েজ
2024.03.21
ঢাকা
হিজড়া পরিচয়েই উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া যাবে জাতীয় সংসদে হিজরা ও ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য সংরক্ষিত আসনের দাবিতে 'সুস্থ জীবন' নামে একটি সংস্থার আয়োজনে ট্রানজেন্ডরা ঢাকার শাহবাগ থেকে র‍্যালি বের করে। ২০ নভেম্বর ২০২২।
[মো: হাসান/বেনারনিউজ]

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মনোনয়ন ফরমে পুরুষ ও নারীর পাশাপাশি লৈঙ্গিক পরিচয়ে হিজড়া যুক্ত করা হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বেনারকে জানিয়েছেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালায় আরও বেশ কয়েকটি পরিবর্তনের পাশাপাশি এই সুযোগটি সৃষ্টি করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার নির্বাচন ভবনে প্রথম ধাপে ১৫২ উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন তিনি।

আগামী ৮ মে অনুষ্ঠেয় এই নির্বাচনে হিজড়া কমিউনিটির সদস্যরা নিজ পরিচয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন।

এর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এই সুযোগটি তৈরি হয়েছিল। তবে জাতীয় নির্বাচন অনেক বেশি রাজনৈতিক হওয়ায় সেখানে এটা তেমন একটা প্রভাব পড়েনি।

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের নেতারা বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সাধারণত প্রান্তিক জনপদের মানুষ সক্রিয় থাকে বলে হিজড়াদের উৎসাহিত করবে।

হিজড়া পরিচয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ তৈরি হওয়ায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন দেশের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের জন প্রতিনিধি নজরুল ইসলাম ঋতু, যিনি ঋতু হিজড়া নামে বেশি পরিচিত।

গত বছরের নভেম্বরে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ছয় নম্বর ত্রিলোচনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করে নির্বাচিত হন ঋতু।

বৃহস্পতিবার বেনারের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, “আমি যখন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছি, তখন মনোনয়ন ফরমে লিঙ্গ পরিচয়ের জন্য দুটি ঘর ছিল। সেখানে আমি পুরুষ ও মহিলা দুটিতেই টিক দিয়েছি। লিঙ্গ পরিচয় তো আমার অধিকার, সেই অধিকার থেকে আমি বঞ্চিত হয়েছিলাম।

“এখন যখন কোনো হিজড়া নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে এবং নিজের লিঙ্গ পরিচয়ের ঘরে টিক দিতে পারবে; এই আনন্দ আসলে আমাদের মতো মানুষরা ছাড়া কেউ বুঝতে পারবে না। আমি এই ঘটনায় অনেক আনন্দিত,” বলেন তিনি।

এই সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন হিজড়াদের অধিকার নিয়ে কাজ করা মানবাধিকারকর্মী শোভা সরকার।

তিনি বেনারকে বলেন, “এটা আমাদের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। তবে এটা সত্য যে, আরও বেশ কিছু জটিলতা আছে যেগুলোর নিরসন জরুরি। যেমন—সংরক্ষিত নারী আসনে হিজড়াদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার  সুযোগ আগে ছিল, এখনো তা থাকবে কী না।”

তিনি বলেন, হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকায় হিজড়া যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষের মূলধারায় আসতে আরও অনেক উন্নয়ন প্রয়োজন।

“স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যেহেতু হিজড়া পরিচয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ তৈরি হয়েছে, আশা করা যায়, আমাদের জনগোষ্ঠীর অনেকেই নির্বাচনে আগ্রহ দেখাবে,” বলেন তিনি।

দেশের আটটি বিভাগের ৬৪টি জেলায় মোট ৪৯৫টি উপজেলা রয়েছে। এই উপজেলাগুলোর অধিকাংশতেই আগামী কয়েক মাসজুড়ে নির্বাচন হবে।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে সিদ্ধান্ত নিয়ে ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে সরকার। এরপর ভোটার তালিকায় লিঙ্গ পরিচয় হিসেবে নারী পুরুষের পাশাপাশি যুক্ত হয় হিজড়া।

হিজড়াদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক

দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে হিজড়া জনগোষ্ঠীর যে সংখ্যা দেখানো হয়, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এই জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো মনে করে, সরকারের কোনো হিসাবেই হিজড়াদের প্রকৃত সংখ্যা প্রতিফলিত হয়নি।

চলতি মাসের শুরুতে নির্বাচন কমিশন প্রকাশিত হিসাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে ভোটার সংখ্যা সংখ্যা ১২ কোটি ১৮ লাখ ৫০ হাজার ১৬০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ছয় কোটি ২১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৮৭ জন, নারী পাঁচ কোটি ৯৭ লাখ চার হাজার ৬৪১ ও হিজড়া ৯৩২ জন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত সর্বশেষ জনশুমারি ও গৃহগণনা, ২০২২ অনুযায়ী দেশে মোট জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। এই হিসাবে দেখানো হয়েছে, দেশে হিজড়ার সংখ্যা ১২ হাজার ৬২৯ জন।

হিজড়াদের অবহেলিত-অনগ্রসর গোষ্ঠী উল্লেখ করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, “সমাজ সেবা অধিদপ্তরের জরিপ মতে বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার।”

ওয়েবসাইটে আরও বলা হয়েছে, সমাজে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার এই জনগোষ্ঠীর পারিবারিক, আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা ব্যবস্থা, বাসস্থান, স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ; হিজড়াদের সমাজের মূল স্রোতধারায় এনে দেশের সার্বিক উন্নয়নে তাদের সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে সরকার হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

হিজড়াদের অধিকার আদায় ও বিকল্প জীবিকায়নের লক্ষ্যে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করে আসছে বেসরকারি সংস্থা বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি।

এই সংগঠনের একজন মুখপাত্র বেনারকে জানান, এই সংস্থাটি এককভাবেই প্রায় ২০ হাজার হিজড়াকে সেবা দিয়ে আসছে। এর বাইরেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নানাভাবে হিজড়া রয়েছে।

অধিকারকর্মী শোভা সরকার বেনারকে বলেন, “আমাদের কাছে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে আমাদের কাজ করার যে অভিজ্ঞতা, তাতে আমাদের ধারণা দেশজুড়ে প্রায় দুই লাখ হিজড়া রয়েছে।”

তিনি বলেন, সরকার যখন বিভিন্ন রকম জরিপ বা শুমারি করে, তখন জরিপ কর্মীরা সাধারণত হিজড়াদের ডেরায় যান না। ফলে কখনোই হিজড়াদের প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না।

উপজেলা নির্বাচনে জামানত বাড়ল ১০ গুণ

সংশোধিত উপজেলা নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা অনুযায়ী, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এক লাখ টাকা জামানত দিতে হবে, আর ভাইস চেয়ারম্যান পদে জামানত দিতে হবে ৭৫ হাজার টাকা।

আগে এই দুই পদে জামানত ছিল ১০ হাজার টাকা।

নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের আট ভাগের এক ভাগের কম বা ভোটের সাড়ে ১২ শতাংশের কম পেলে জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার বিধান ছিল। নতুন বিধিমালায় এটি ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার বিধানও শিথিল করা হয়েছে। চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে ২৫০ ভোটারের সমর্থনসূচক সই মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়ার বিধান একেবারেই তুলে দেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ঘোষণা দিয়েছে, উপজেলা নির্বাচনে দলীয়ভাবে কাউকে মনোনয়ন দেবে না দলটি। এই সিদ্ধান্তের ফলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।