বজ্রপাত ঠেকাতে তালগাছ রোপণ, স্থানীয় ধারণা এখন সরকারি কর্মসূচি
2017.01.26

নওগাঁর পোরশা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের অন্তত ১৫ কিলোমিটার রাস্তার দুপাশে চোখে পড়ে সারি সারি তালগাছ। এটা কোনো সরকারি উদ্যোগের ফল নয়। গ্রামের কৃষক গৌতম কুমার সাহা নিজ উদ্যোগে এগুলো লাগিয়েছেন।
চার বছর ধরে রাস্তার পাশে ও সরকারি জমিতে তালগাছ রোপণ করছেন তিনি। গাছগুলো দেড় থেকে দুই ফুট বড় হয়েছে। প্রকৃতি রক্ষা, মাটির ক্ষয়রোধ, বজ্রপাত থেকে মানুষকে রক্ষার জন্য একে কার্যকর পন্থা হিসেবে মনে করা হয়।
বৃহস্পতিবার টেলিফোনে তিনি বেনারকে বলেন, “ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি উঁচু গাছের কারণে বজ্রপাত থেকে বাঁচা যায়। এখন উঁচু গাছ নেই। তালগাছ লাগালে সেখানে বজ্রপাত আটকে যাবে। মানুষ মারা যাবে না। এ জন্য গাছ লাগাই।”
বজ্রপাত থেকে সুরক্ষা পেতে স্থানীয় এই ধারণাকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে সারা দেশে ১০ লাখ তালগাছ রোপণের এক অভিনব কর্মসূচি নিয়েছে সরকার। এই কর্মসূচি কতটা সফল হবে এবং বজ্রপাত থেকে তা মানুষকে কতটা সুরক্ষা দেবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ বেনারকে বলেছেন, “বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে তালগাছ রোপণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বজ্রের আঘাত সাধারণত উঁচু স্থানে হয়ে থাকে। তাল গাছ উঁচু হওয়ায় এটাকেই কার্যকর উপায় হিসেবে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।”
সরকারের কর্মকর্তারা বলেছেন, এটা কোনো স্বতন্ত্র প্রকল্প নয়। ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা)’ ও ‘কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা)’ কর্মসূচির নীতিমালা পরিবর্তন করে তার সঙ্গে তাল গাছ রোপণের বাধ্যবাধকতা জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
বাস্তবায়ন কৌশল ব্যাখ্যা করে রিয়াজ আহমেদ বেনারকে বলেছেন, “কাবিখা প্রকল্পের আওতায় প্রতি টন চালের বিনিময়ে যে পরিমাণ কাজ হবে তার সঙ্গে ১০ টি করে গাছ রোপণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।”
বজ্রপাতে মৃত্যুর পরিসংখ্যান
বজ্রপাতে মৃত্যুর একেবারে সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের হাতে নেই। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তালিকায় ২০১০ সাল থেকে দেড় হাজারের মতো মানুষ নিহত হয়েছেন বজ্রপাতে।
জাতীয় দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১১ সালে ১৭৯ জন মারা যান, আর ২০১৫ সালে ২৭৪ জন। গত বছর বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন ১০৩ জন।
মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে প্রতিবছর গড়ে দুইশ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বজ্রপাতে। এ হার বিশ্বের দ্বিতীয়।
গত বছর দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর শিকার মানুষের বেশির ভাগই হাওর অঞ্চলের ৯ জেলার। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ছিল সুনামগঞ্জে। সম্প্রতি দেশে বজ্রপাতের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে এটিকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে গণ্য করছে সরকার।
প্রায় ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশে মাত্র ১০ লাখ গাছ লাগিয়ে বড় কোনো উপকার পাওয়া যাবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ । বজ্রপাত নিরোধে উন্নত বিশ্ব কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে তা জানার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনগুলো ঘেঁটে দেখেছেন বেনার প্রতিবেদক।
আমেরিকা ও ইউরোপের সরকারি ও বেসরকারি ওয়েবসাইটগুলো ঘেঁটে কোথাও তাল গাছ লাগিয়ে বজ্রপাত থেকে প্রতিকার পাওয়ার পরামর্শ পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, এটা ধারণাপ্রসূত, কিছুটা অভিজ্ঞতা নির্ভর এবং নিরীক্ষাধীন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মিহির লাল সাহা বেনারকে বলেছেন, “উঁচু গাছ বজ্রপাত থেকে রক্ষা করে—এটা বিজ্ঞানসম্মত ধারণা হলে তালগাছ কার্যকর হতে পারে। কারণ তাল গাছ পাম গোত্রের অন্যতম দীর্ঘ গাছ যা উচ্চতায় ৪০ থেকে ৫০ ফুট পর্যন্ত হয়।”
তিনি বলেছেন, এই উদ্যোগ কতটা বাস্তবসম্মত তা প্রমাণ হতে অনেক বছর লাগবে। কারণ তাল গাছ বড় হতে অনেক বছর লেগে যায়।”
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ স্বীকার করেন যে, তালগাছ লাগিয়ে বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়—এ রকম কোনো সুনির্দিষ্ট গবেষণা প্রতিবেদন তাদের কাছে নেই।
এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, “বজ্রপাত নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা–নিরীক্ষা হয়নি। স্বাভাবিকভাবে ধরে নেওয়া হয় যে, গাছের ওপর বজ্রপাত হলে মানুষের জীবন রক্ষা পেতে পারে।”
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে এই কর্মসূচি গ্রহণ করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। তালগাছ রোপণের ফলে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে—এ রকম একটা তথ্যের ভিত্তিতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে তিনি বেনারকে জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, “গাছ বড় হতে অনেক সময় লাগে এটা ঠিক। এ জন্য কাজগুলো ফেলে রাখা যায় না। এখন শুরু করলে মানুষ ভবিষ্যতে সুফল পাবে।”
তালগাছ লাগানোর এই উদ্যোগকে সমর্থন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক মাহবুবা নাসরিন।
বেনারকে তিনি বলেন, “এক সময় দেশে প্রচুর তাল, খেজুর, নারিকেল ও সুপারি গাছ ছিল। সে সময় বজ্রপাত হতো এসব গাছের ওপর। ফলে বজ্রের আঘাত নিচে নেমে আসত না এবং মানুষ বেঁচে যেত।”
বজ্রপাত থেকে রক্ষায় তালগাছ রোপণের উদ্যোগ কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও এই গাছের নানা উপকারিতা রয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, তাল পাতা দিয়ে ঘর ছাওয়া, হাতপাখা, চাটাই, মাদুর এবং কাণ্ড দিয়ে বাড়ি ও নৌকা তৈরির কাজ হয়। তালের ফল এবং তালশাঁস পুষ্টিকর খাদ্য।
এ ছাড়া তাল গাছের কাণ্ড থেকে রস সংগ্রহ হয় এবং তা থেকে গুড়, পাটালি, মিছরি এবং একপ্রকার চোলাই মদ তৈরি হয়। এই গাছ দীর্ঘজীবী। কমবেশি ১০০ বছর বাঁচে এবং ফল দেয়।