আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.03.29
ঢাকা
ঢাকায় বিশ্ব আদিবাসী দিবসের শোভাযাত্রা চলাকালে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে একটি ব্যানার দিয়ে মাথার ছাদ তৈরি করে নিয়েছেন আদিবাসী নারীরা। ঢাকায় বিশ্ব আদিবাসী দিবসের শোভাযাত্রা চলাকালে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে একটি ব্যানার দিয়ে মাথার ছাদ তৈরি করে নিয়েছেন আদিবাসী নারীরা। ৯ আগস্ট ২০১৬।
AP

পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অধিকাংশ ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য বাঞ্ছিতা চাকমা। তবে একটি বিধির কারণে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ওই সব ঘটনা তদন্ত করতে পারে না বলে জানিয়েছেন তিনি।

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের আদিবাসীদের ওপর মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রতিবেদন-২০১৭ প্রকাশ অনুষ্ঠানে এই মন্তব্য করেন তিনি। রাজধানীর ডেইলি স্টার সম্মেলন কক্ষে কাপেং ফাউন্ডেশন প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এ অনুষ্ঠান আয়োজন করে।

বক্তৃতায় তিনি আরও বলেন, “অনেকেই হয়তো জানেন না, মানবাধিকার কমিশনের আইনে একটা বিধি আছে সেখানে, শৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে সেটা তদন্ত করা যাবে না। কেবল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবেদন চাইতে পারা যাবে। এখানে হচ্ছে সবচেয়ে বড় বাধা।”

তিনি বলেন, “এই যে পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সমতল অঞ্চলে যে সকল মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, প্রধানত ঘটে কিন্তু শৃঙ্খলাবাহিনীর দ্বারাই।”

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এ সকল ঘটনা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রতিবেদন চাইতে পারে বলে জানান তিনি।

“যদি আমরা তদন্তই না করতে পারি তাহলে তো এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো ঘটতেই থাকবে। সে কারণেই এই আইনের সংশোধন প্রয়োজন,” বলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এই সদস্য।

সভা শেষে বাঞ্ছিতা চাকমা বেনারকে বলেন, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উত্থাপিত হলে সেসব ঘটনা তদন্ত করার ক্ষমতা চেয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি প্রস্তাবনা পাঠাতে যাচ্ছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।

তিনি বলেন, “জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের আইনি ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। এই কমিটি মানবাধিকার সুরক্ষা করতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কী কী ক্ষমতা দেওয়া উচিত সে ব্যাপারে সরকারের কাছে সুপারিশ করবে।”

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বেনারের কাছে কমিটি গঠনের কথা স্বীকার করে বলেছেন, “আইনি সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দেশের ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সদস্যসহ সকল নাগরিকের মানবাধিকার রক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।”

তবে বাংলাদেশ নিরাপত্তা বাহিনীদের মুখপাত্র প্রতিষ্ঠান আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের পরিচালক লে. কর্নেল আলমগীর কবির বেনারকে বলেন, “আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর কোনো সদস্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বা কোথাও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট তেমন কিছু আমার জানা নাই।”

আইন মন্ত্রণালয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বিধিটি সংশোধনের জন্য তাদের সাথে আলোচনা করেছে। তবে, বিধিটি সংশোধনের ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

ঢাকায় ‘বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার রিপোর্ট ২০১৭’ এর মোড়ক উন্মোচন ও আলোচনা সভায় অতিথিরা। ২৯ মার্চ ২০১৮।
ঢাকায় ‘বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার রিপোর্ট ২০১৭’ এর মোড়ক উন্মোচন ও আলোচনা সভায় অতিথিরা। ২৯ মার্চ ২০১৮।
নিউজরুম ফটো

 

২০১৭ প্রতিবেদন

২০১৭ সালের আদিবাসীদের সার্বিক মানবাধিকার-পরিস্থিতি উদ্বেগজনক ছিল বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা প্রতিবেদন তুলে ধরে বলেন, এ বছর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা জনমনে চরম উদ্বেগ ও আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে।

তিনি বলেন, “বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী অধিকার কর্মীদের চাঁদাবাজি, অস্ত্রধারী, সন্ত্রাসী ইত্যাদি সাজানো অভিযোগে অভিযুক্ত করে মিথ্যা মামলা দায়ের, ধরপাকড়, জেলে প্রেরণ, ক্যাম্পে আটক ও নির্যাতন, ঘরবাড়ি তল্লাশি ইত্যাদি নিপীড়ন-নির্যাতন জোরদার করেছে।”

কাপেং ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সালে অন্তত পার্বত্য চট্টগ্রামের ৭ জনসহ সারা দেশে ১০ জন আদিবাসীকে হত্যা, পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৪১ জন আদিবাসী অধিকার কর্মী ও নিরীহ গ্রামবাসীকে গ্রেপ্তার ও সাময়িক আটক এবং ১৬১ জনের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দায়ের করা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনী, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কর্তৃক নিপীড়ন-নির্যাতন ও হামলায় ২০৩ জন আহত এবং ৭৯টি ঘরবাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়েছে।

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্মে ২০১৬ সালে অগ্নিসংযোগ, উচ্ছেদ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উচ্ছেদ হওয়া ১২০০ সাঁওতাল পরিবারকে এখনো একটি ‘সন্তোষজনক সমাধান’ দেওয়া সম্ভব হয়নি বলে উল্লেখ করেন পল্লব চাকমা।

২০১৭ সালে আদিবাসী নারীর বিরুদ্ধে মোট ৪৮টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে উল্লেখ করে তিনি জানান, এসব ঘটনায় মোট ৫৮জন আদিবাসী মেয়েশিশু যৌন বা শারীরিকভাবে আক্রমণের শিকার হন।

এদের মধ্যে, ধর্ষণের শিকার হয় কমপক্ষে ১২জন, ৯ জনকে হত্যা ও ধর্ষণের পর হত্যা এবং ৯ জনকে শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়।

এসবের মধ্যে ৪ আদিবাসী নারী গণধর্ষণ এবং আটজন নারী ও কিশোরীকে অপহরণের ঘটনা ঘটে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

এ ক্ষেত্রে ৪৮ ঘটনায় জড়িত হিসাবে ৭৫ জনের মধ্যে ৬৪ জন বাঙালি ছিল।

অনুষ্ঠানে আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের সদস্য উষাতন তালুকদার বলেন, “দুইটা মারমা নারীকে কোন অজ্ঞাত কারণে, কী আইনের বলে একটি জেলা পরিষদ প্রশাসকের বাড়িতে পুলিশি প্রহরায় রাষ্ট্র কর্তৃক আটকে রাখা হয়েছে? কেউ কিছু বলতে পারে না।”

তিনি বলেন, “চাকমা রাজা ও রানি অপমানিত হয়েছেন, তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর কারণে। এখনো কেন জানি তাদের সেখানে রাখা হয়েছে। সরকার কিছু বলছে না, কেউ কিছু বলছে না।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, “প্রতিবছরই প্রতিবেদন দেওয়া হয়, কিন্তু এর ভাষা বদলাচ্ছে না, পরিসংখ্যান বদলাচ্ছে না। তার মানে প্রতিকারহীন অবস্থায় আছে।”

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সুলতানা কামাল মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে বহু আদিবাসী ‘নীরবে দেশত্যাগ’ করছে দাবি করে বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের যে রিপোর্টটি হয়েছিল প্রথমে, সেটার নাম ছিল ‘দিস ল্যান্ড ইজ নট আওয়ার্স’ অর্থাৎ এটা আমার দেশ নয়।

তিনি বলেন, “আমাদের দেশের কিছু লোককে এখনো ভাবতে হচ্ছে, এই দেশ আমার না। কেন মনে হচ্ছে, কেননা এই দেশ আমাকে আশ্রয় দিচ্ছে না, এ দেশটা আমার পাশে দাঁড়াচ্ছে না, এই দেশটা যখন আমার অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে তখন সেই অধিকার লঙ্ঘনের বিচার করছে না।”

কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন রবীন্দ্রনাথ সরেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, অক্সফামের কর্মসূচি পরিচালক এম বি আক্তার বক্তব্য দেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।