নিরাপত্তা হেফাজতে আদিবাসী কলেজ ছাত্রের মৃত্যু নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া
2017.04.24
ঢাকা

রমেল চাকমা নামে এক আদিবাসী ছাত্রের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়ি জনপদে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে সেনা সদস্যদের নির্যাতনে ওই ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। অভিযোগ অস্বীকার করেছে সেনাবাহিনী।
এর প্রতিবাদে রবিবার রাঙামাটিতে সকাল-সন্ধ্যা সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। গত কয়েক দিন ধরে বিক্ষোভ হচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক লেখালেখি হচ্ছে।
ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। এর সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নসহ পার্বত্য আদিবাসীদের বিভিন্ন দাবিতে সরব হয়ে উঠেছে আদিবাসী, ছাত্র ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
গত ৫ এপ্রিল নানিয়ারচর বাজার থেকে রমেল চাকমাকে আটক করে সেনাবাহিনী। পরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯ এপ্রিল তিনি মারা যান।
ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অনিল চাকমা বেনারকে বলেছেন, “সেনা সদস্যদের নির্মম নির্যাতনেই যে রমেলের মৃত্যু হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। বিচার এড়ানোর জন্য লাশ তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।”
সেনা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
সেনা সদস্যদের নির্যাতনে রমেলের মৃত্যুর যে অভিযোগ প্রচার করা হচ্ছে, তা অমূলক বলে দাবি করেছেন আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) একজন মুখপাত্র। তিনি বলেছেন, রমেল চাকমা নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক অবস্থায় বেশি সময় ছিলেন না। তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল এবং সেখান থেকে তাকে চিকিৎসার জন্য মেডিকেলে পাঠানো হয়েছিল।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে আইএসপিআর এর পরিচালক লে. কর্নেল রাশিদুল হাসান বেনারকে বলেন, ‘‘গত ৫ এপ্রিল দুটি বাস লুট এবং একটি ট্রাক পোড়ানোর মামলায় নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা তাকে আটক করেন। তাকে আটক করতে গেলে সে পাহাড়ে পালানোর চেষ্টা করে। এসময় পাহাড় থেকে রাস্তার ওপর পড়ে যায় এবং চলমান সিএনজি’র সঙ্গে আঘাত লেগে সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে।”
রাশিদুল বলেন, “ওই দিনই তাকে থানায় হস্তান্তর করা হয়৷ এরপর পুলিশের তত্ত্বাবধানে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়৷”
“৫ এপ্রিল থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯ এপ্রিল তিনি মারা যান৷ গত ২১ এপ্রিল দুপুর দেড়টা থেকে ৪টার মধ্যে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, নানিয়ারচর থানা পুলিশ, কাউখালী উপজেলার ইউএনও এবং তার আত্মীয় স্বজনের উপস্থিতিতে ধর্মীয় রীতি মেনে তার দেহ দাহ করা হয়। সেনাবাহিনীর নির্যাতনে তিনি মারা গেছেন বলে যে অভিযোগ করা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন,” বলেন রাশিদুল।
পুলিশের বক্তব্য
সেনা কর্তৃপক্ষের এই বক্তব্যের সাথে একমত নন পুলিশের কর্মকর্তারা। নানিয়ারচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ বেনারকে বলেছেন, “বাস লুট কিংবা ট্রাক পোড়ানোর কোনো মামলায় রমেলের নাম নেই। তার নামে অন্য কোনো মামলাও রেকর্ডে নেই।”
তিনি বলেন, ‘‘আমরা রমেলকে আটক করিনি এবং হাসপাতালেও ভর্তি করিনি৷ কেন তাকে আটক করা হয়েছিল এবং কী অবস্থায় তাকে মেডিকেলে পাঠানো হয়েছিল তা আমরা বলতে পারব না।”
তবে ২১ এপ্রিল দুপুরে পুলিশের তত্ত্বাবধানেই রমেলের শেষকৃত্য সম্পাদনের কথা স্বীকার করেছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি বলেছেন, “শেষকৃত্যের সময় রমেলের পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। লাশের অমর্যাদা করা হয়নি। যথাযথ ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসরণ করেই তাকে দাহ করা হয়েছে। শুধু বিক্ষোভ ও বিশৃঙ্খলা এড়ানোর জন্য আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালন করেছে।”
প্রতিবাদ, বিক্ষোভ
এইচএসসি পরীক্ষার্থী রমেল চাকমা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও দ্রুত বিচারের দাবিতে গত রবিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ ও মিছিল করেছে বিভিন্ন বাম ছাত্রসংগঠনের যৌথ প্লাটফরম প্রগতিশীল ছাত্রজোট।
সমাবেশে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের সমন্বয়ক জিএম জিলানী শুভ বলেন, “রমেল চাকমার হত্যাকাণ্ড মানবাধিকার ও সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সেনাবাহিনীকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য জড়িত সেনা সদস্যদের চাকরিচ্যুত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত।”
সমাবেশে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সুলভ চাকমা বলেন, “আমরা সবাই একত্রে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও আমরা পাহাড়ি জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সেনাবাহিনী কর্তৃক অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন, গুম, হত্যা, দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার বহিঃপ্রকাশ রমেল চাকমাকে বর্বরভাবে হত্যা।”
হত্যার তদন্ত ও বিচার দাবিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে শিক্ষার্থীরা।
পুলিশ মামলা নেয়নি?
পিসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনিল চাকমা বেনারকে বলেছেন রমেলের পরিবার মামলা করতে চাইলেও মামলা নেয়নি পুলিশ কর্তারা। তিনি বলেছেন, “রমেলের বাবা শান্তি চাকমা মামলা দায়ের করার জন্য নানিয়ারচর থানায় গিয়েছিলেন।” তবে ওসি আব্দুল লতিফ দাবি করেছেন কেউ মামলা করতে থানায় আসেনি। এ ব্যাপারে শান্তি চাকমার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে মৃত্যুর আগেই শান্তি চাকমা বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের কাছে তার ছেলেকে আটক ও নির্যাতনের প্রতিকার চেয়ে একটি আবেদন পাঠিয়েছিলেন। মানবাধিকার কমিশনের কাছে প্রেরিত সেই আবেদনের কপি বহু প্রতিবাদকারী ফেসবুকে শেয়ার করেছেন।
পার্বত্য কমিশনের বিবৃতি
রমেল চাকমাকে আটকের পরে নির্মমভাবে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক কমিশন।
ঘটনার বিচারিক তদন্ত কমিটি গঠন ও অপরাধীদের শাস্তি, ন্যায় বিচার ও সম্মানজনক ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছে কমিশন।
ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিজেদের দায় অস্বীকার করে একে অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়টি ‘অধিকতর উদ্বেগের’ বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
কমিশন বলেছে, “একটা স্বাধীন রাষ্ট্রে বিনা বিচারে একদিকে এভাবে একজন শিক্ষার্থীর জীবন অকালে কেড়ে নেওয়া ও অন্যদিকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর উল্লেখিত আচরণ কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।”