রাঙ্গামাটিতে আদিবাসী গ্রামে বাঙালিদের ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ
2017.06.02
ঢাকা

আপডেটঃ ৩ জুন ২০১৭, ইস্টার্ন টাইম ভোর ০২.০০
এক বাঙালি যুবককে হত্যার ঘটনায় স্থানীয় উত্তেজিত বাঙালিরা শুক্রবার রাঙ্গামাটি জেলার একটি গ্রামে ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর বাড়ি-ঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে।
নিহত বাঙালি যুবক নুরুল ইসলাম নয়ন ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাতেন। তিনি লংগদু সদর ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা সড়কে চার কিলো এলাকা থেকে নয়নের লাশ উদ্ধার করা হয়। তাঁর বাড়ি রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু উপজেলায়। শুক্রবার সকাল আটটায় তাঁর লাশ লংগদু বাত্যপাড়া গ্রামে নিয়ে আসা হয়।
“নয়নকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে; আমরা এখনো জানি না কে বা কারা বাঙালি যুবক নয়নকে হত্যা করেছে। অপরাধীদের ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে,” বেনারকে বলেন খাগড়াছড়ি জেলার পুলিশ সুপার আলী আহমদ খান।
এদিকে নয়নের হত্যাকারী সম্পর্কে পুলিশ নিশ্চিত হতে না পারলেও স্থানীয় বাঙালিরা এর জন্য আদিবাসীদের দায়ী করে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়।
“তার লাশ শুক্রবার লংগদুতে আনা হলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং স্থানীয় জনতা তিন টিলা গ্রামে ভাঙচুর চালায়, অগ্নিসংযোগ করে। এতে ‘উপজাতীয়দের’ বেশ কিছু ঘরবাড়ি এবং দোকান-পাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়,” বেনারকে বলেন রাঙ্গামাটি জেলার পুলিশ সুপার সৈয়দ তরিকুল হাসান।
“লংগদুতে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এখানে তিন টিলায় প্রায় ২০০ বাড়ি-ঘর ও দোকানপাট ভাঙচুর করেছে বাঙালিরা,” বেনারকে টেলিফোনে জানান স্থানীয় অধিবাসী সাধন চাকমা।
“এখনো সেখানে উত্তেজনা বিরাজ করছে; আমরা সেখানে ফোর্স মোতায়েন করেছি। সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। আসামী গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে,” জানান রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপার।
“এখন পুলিশ টহল দিচ্ছে। বাইেরর কাউকে এই এলাকায় প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না,” বলেন সাধন চাকমা।
তিনি জানান, “পরিস্থিতি থমথমে; এখানকার আদিবাসীরা ভয়ে ভয়ে আছে কখন যেন তাদের ওপর আবার আক্রমণ হয়।”
এদিকে খাগড়াছড়ি জেলাতেও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন।
“এই ঘটনার পর খাগড়াছড়ি জেলায়ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে,” বেনারকে জানান খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার।
উল্লেখ্য, রাঙ্গামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় ১৯৭৫ সালের পর থেকে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দরিদ্র বাঙালিদের পুনর্বাসিত করেন। এরপর থেকে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ লেগেই আছে।
১৯৯৭ সালে সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির শান্তি চুক্তির পর পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়। কিন্তু মাঝেমধ্যেই পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে বিরোধ ও অবিশ্বাস চরমে ওঠে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রায়ই দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় পাহাড়িরা সেখানকার বাঙালিদের ‘সেটেলার’ হিসেবে গণ্য করেন।
তিন টিলা গ্রামের অধিবাসী মণি শংকর চাকমা টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “সকাল আনুমানিক দশটার দিকে একদল বাঙালি এসে বিনা উসকানিতে আমাদের বাড়ি-ঘর ভাঙচুর করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়।”
“আমরা কী দোষ করেছি যে আমাদের বাড়ি-ঘর পোড়াতে হবে? আমরা কি হত্যাকারী? এভাবে আমাদের পথে বসিয়ে লাভ কী? এই ভাঙা বাড়ি-ঘর কীভাবে ঠিক করব?”
মণি বলেন, পুলিশ যেন তদন্ত করে খুনীদের বের করে শাস্তি দেয়। আর সরকার যেন আমাদের বাড়ি-ঘর ও দোকান-পাট মেরামত করার জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য দেয়।
নিন্দা ও প্রতিবাদ
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। জনসংহতি সমিতি তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, সংঘবদ্ধ সাম্প্রদায়িক হামলায় লংগদু সদরের তিন টিলা এলাকায় জুম্মদের দুই শতাধিক ঘরবাড়ি ও দোকানপাট এবং মানিকজুরছড়ায় কমপক্ষে ৪০টি ঘরবাড়িসহ জুম্মদের প্রায় ২৫০টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এতে আরো বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা, সর্বোপরি জুম্ম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার হীন উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রযন্ত্র তথা শাসকশ্রেণির মদদে এই হামলা সংঘটিত হয়েছে বলে জনসংহতি সমিতি মনে করে।
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিয়াউদ্দিন তারেক আলী ও সাধারণ সম্পাদক সালেহ্ আহমেদ এক বিবৃতিতে আদিবাসীদের বাড়ি ঘর লুট পাট ও অগ্নিসংযোগের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, “আমরা মনে করি এ ধরনের ঘটনা দেশের সম্প্রীতি, স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র ও সংবিধানের শাসনের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের ফসল।”
নোট: প্রতিবেদনে প্রকাশিত মূল ছবিটি সঠিক না হওয়ায় ছবিটি পরিবর্তন করা হয়েছে।