পাহাড়িদের বাড়ি-ঘরে আগুনের বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি
2017.06.06
ঢাকা

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি জেলার লংগদুতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বাড়ি-ঘরে আগুন লাগানোর ঘটনা তদন্তের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
সোমবার অ্যামনেস্টি ওয়েবসাইটে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ‘অবশ্যই’ বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
এদিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তিন সদস্যদের একটি দল লংগদু উপজেলার তিনটিলা গ্রাম পরিদর্শন করেছে। তারা আক্রমণের ঘটনা তদন্ত করছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক।
“এই আক্রমণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের তদন্ত আগামী কয়েক দিনের মধ্যে শেষ হবে। এরপর আমরা আমাদের মতামত জানাব,” তিনি বলেন।
তবে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান বেনারকে বলেন, “দেখুন অ্যামনেস্টি বিবৃতি দিতেই পারে। আবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও তদন্ত করতে পারে। তবে আমাদের কাছে পুলিশ মামলার পর যে তদন্ত করে সেটাই সবচে বেশি গ্রহণযোগ্য।”
তিনি বলেন, “পুলিশ ঘটনা তদন্ত করছে। ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।”
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, “অপরাধীরা পার পাবে না।”
তবে স্থানীয় বাসিন্দারা পুলিশি তদন্তের ওপর আস্থা না রাখতে পেরে ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করেছেন।
এ প্রসঙ্গে লংগদুর বাসিন্দা রাসেল চাকমা বেনারকে বলেন, “আমরা মনে করি না যে পুলিশ নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের বের করতে পারবে। আমাদের অতীত ঘটনা থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই তা হলো আমরা বিচার পাব না।”
তিনি বলেন, কল্পনা চাকমাকে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অপহরণ করা হয়। পুলিশ আজ পর্যন্ত সেই তদন্ত শেষ করতে পারেনি।
“তাই আমরা আদিবাসীরা পুলিশের তদন্তে আস্থা রাখতে পারি না। আমরা বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই,” রাসেল বলেন।
গত শুক্রবার বাঙালি যুবক নুরুল ইসলাম নয়নকে হত্যার ঘটনায় স্থানীয় উত্তেজিত বাঙালিরা রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলার তিনটিলা গ্রামে ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর দুই শতাধিক বাড়ি-ঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। পাহাড়িরা ওই ঘটনার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেদিন পুলিশ ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। পুলিশ বাদী হয়ে অগ্নিকাণ্ড ও ভাঙচুরের মামলা করেছে।
নিহত যুবক নয়ন ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাতেন। তিনি লংগদু সদর ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। দুষ্কৃতকারীরা তাকে হত্যা করে।
নয়ন হত্যার পর পাহাড়িদের ওপর হামলার প্রতিবাদে পাহাড়িদের বিভিন্ন সংগঠন বিক্ষোভ করে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে রাঙামাটির সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার সোমবার জাতীয় সংসদে লংগদুর ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন। একই সঙ্গে তিনি লংগদুতে একটি সংসদীয় দল প্রেরণের দাবি জানান।
আরেক সংসদ-সদস্য এস এম আবুল কালাম আজাদ লংগদুতে আক্রমণের ঘটনা তদন্ত করার জন্য একটি সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানান।
তবে এখন পর্যন্ত লংগদুতে সংসদীয় দল প্রেরণের অথবা ঘটনা তদন্ত করার জন্য সংসদীয় কমিটি গঠনের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে বেনারকে জানিয়েছেন সরকারি দলীয় হুইপ আতিউর রহমান আতিক।
প্রসঙ্গত সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের পর থেকে রাঙামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় দরিদ্র বাঙালিদের পুনর্বাসিত করেন। স্থানীয় পাহাড়িরা সেখানকার বাঙালিদের ‘সেটেলার’ হিসেবে গণ্য করেন।
১৯৭৫ এর পর থেকে স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ লেগেই আছে।
দাতাদের অর্থায়নে বাঙালি ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আস্থা তৈরির জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। তবে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে অবিশ্বাস এখনো চরমে।
১৯৯৭ সালে সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির শান্তি চুক্তির পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। কিন্তু মাঝেমধ্যেই পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে বিরোধ ও অবিশ্বাস চরমে ওঠে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রায়ই দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
পাহাড়িদের বড় অংশ শান্তি চুক্তির পক্ষে হলে ও বাঙালিরা এর তীব্র বিরোধী।
বাঙালিরা হরতাল ডেকেছে
নুরুল ইসলাম হত্যার সুষ্ঠু বিচার ও এবং গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তির দাবিতে আগামী ১১ জুন জেলায় অর্ধদিবস হরতাল ডাক দিয়েছে পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ ও পার্বত্য নাগরিক পরিষদ। গতকাল পার্বত্য নাগরিক পরিষদের দপ্তর সম্পাদক মো. খলিলুর রহমানের স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অর্ধদিবস হরতালের বিষয়টি জানানো হয়।
নুরুল ইসলাম হত্যার তদন্তের মাধ্যমে সুষ্ঠু বিচার ও গ্রেপ্তারকৃতদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে মঙ্গলবার খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়িতে মানববন্ধন করেছে সর্বস্তরের বাঙালিরা।