দুই দশকে পার্বত্য শান্তি চুক্তির আংশিক বাস্তবায়ন
2017.12.12
ঢাকা

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের দুই দশক পরও এর বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মুখপাত্র জনসংহতি সমিতি এখন পাল্টাপাল্টি অবস্থানে। প্রায় দুই দশক আগে এই চুক্তির মাধ্যমে রক্তপাতের অবসান ঘটে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অধিবাসীদের পক্ষ থেকে পার্বত্য জনসংহতি সমিতির মধ্যে এই চুক্তি সাক্ষর হয়। চার খণ্ডে ৭২টি ধারা বাস্তবায়নে দু পক্ষ ঐকমত্যে পৌঁছায়। এ চুক্তির মূল বক্তব্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘উপজাতি’ অধ্যুষিত এলাকা।
আদিবাসীরা বলছেন, সরকার চুক্তির বরখেলাপ করেছে। তারা কাগজপত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতি অধ্যুষিত বললেও, বাস্তবে তাদের কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। যদিও সরকার এই বক্তব্যের বিরোধিতা করছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শান্তি চুক্তির ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে গত শুক্রবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির আদিবাসীদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়েছে। ১৫টি আংশিক ও ৯টি ধারা বাস্তবায়ন করার কাজ শুরু হয়েছে।
এর একদিন পর ডেইলি স্টার মিলনায়তনে জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা সরকারের বিরুদ্ধে চুক্তি বরখেলাপের অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে পাহাড়ে আগুন জ্বলবে।
“শান্তিচুক্তিতে যেভাবে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি, সেনা শাসন প্রত্যাহার, জুম্মদের শিক্ষা–সাংস্কৃতিক অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা রয়েছে, বাস্তবে তা নিশ্চিত হয়নি। উপজাতিরাই যে পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল বাসিন্দা তা কাজ–কর্মে স্বীকার করছে না সরকার,” সন্তু লারমা বলেন।
শান্তিচুক্তি যেভাবে
আদিবাসী নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক ও পাহাড়ি ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭২ সালে স্বায়ত্তশাসনের দাবি নাকচ হওয়ার পর থেকে আদিবাসীদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ১৯৭৩ সালে রাজনৈতিক সংগঠন জনসংহতি সমিতি ও পরে ১৯৭৫ সালে জনসংহতি সমিতির সামরিক শাখা শান্তি বাহিনী সশস্ত্র সংগ্রামে যুক্ত হয়।
তবে, মূল সমস্যা তৈরি হয় যখন আদিবাসীদের ব্যবহৃত ভূমিকে খাস জমি বলে ঘোষণা দিয়ে তা ইজারা দিতে শুরু করে সরকার। কারণ আদিবাসীরা যৌথভাবে জমি ব্যবহার করে থাকে।
১৯৭৯ সালে সরকার পরিকল্পিতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি বসতি স্থাপন শুরু করেছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংহতি সমিতি সে সময় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৩টি জাতিগোষ্ঠীকে এক মঞ্চে সংগঠিত করতে শুরু করে।
১৯৮৯ সালে জাতীয় সংসদে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান—এ তিনটি জেলায় স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠন করা হয়। প্রত্যেক পরিষদের প্রধান ছিলেন আদিবাসীদের মধ্য থেকে নির্বাচিত চেয়ারম্যান। তবে জনসংহতি সমিতি এতে সম্মতি দেয়নি। কারণ আদিবাসীদের মনে সংশয় ও সন্দেহ ছিল ব্যাপক।
ফলে সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে জনসংহতি সমিতি ও শান্তিবাহিনীর ভিন্নমত ও বিরোধ অব্যাহত থাকে।
শেষ পর্যন্ত ১৯৯৭ সালে ধারাবাহিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মোট চারটি খণ্ডে ৭২টি বিষয়ে দু’পক্ষ ঐকমত্যে পৌঁছায়। জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সে সময় অস্ত্র সমর্পণ করে দুই দশক ধরে চলা সশস্ত্র সংগ্রামের ইতি টানেন।
চুক্তি বরখেলাপের অভিযোগ
ভূমি ব্যবস্থাপনায় আঞ্চলিক পরিষদকে দায়িত্ব নিতে না দেওয়াকে বড় বাধা বলে মনে করছে আদিবাসীরা। চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের হাতে এ দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল। তা হয়নি। ২০০১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন পাস করে ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনের একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেটিও কাজ করছে না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে আঞ্চলিক পরিষদের বিবরণ রয়েছে। এই পরিষদের সদস্যরা হলেন; চেয়ারম্যান একজন, আদিবাসী পুরুষ ১২ জন, আদিবাসী নারী দুজন, অ-আদিবাসী পুরুষ ছয়জন ও অ-আদিবাসী নারী একজন। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্যদের ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার বিধান রাখা হয়।
চুক্তিতে বলা হয়েছে, পার্বত্য জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ও আওতাধীন কোনো প্রকার জমি, পাহাড় ও বনাঞ্চল পরিষদের সঙ্গে আলোচনা না করে, পরিষদের সম্মতি না নিয়ে সরকার অধিগ্রহণ ও হস্তান্তর করতে পারবে না।
হেডম্যান, চেইনম্যান, আমিন, সার্ভেয়ার, কানুনগো ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রত্যেকেই থাকবেন পরিষদের নিয়ন্ত্রণে।
তা ছাড়া চুক্তিতে আরও বলা হয়, কাপ্তাই হ্রদে জলমগ্ন জমি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জমির মূল মালিক বন্দোবস্ত হিসেবে পাবেন।
পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা এবং উন্নয়ন কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন ও তত্ত্বাবধান করার দায়িত্ব এই পরিষদের। এমনকি উপজাতি আইন, সামাজিক বিচার-আচার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কার্যক্রমের তদারকি, ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতাও এই পরিষদের ওপর ন্যস্ত করা হয়।
কার্যত এই পরিষদ এসব কাজরে কিছুই করতে পারছে না।
“১৯৭৯-৮০ সালের দিকে পাহাড়িদের জমিতে বাঙালি সেটলারদের বসিয়ে দেওয়া হয়। সেই ভূমি পাহাড়িদের ফিরিয়ে দেওয়া আমাদের অন্যতম দাবী। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আসলে সবটাই শুভঙ্করের ফাকি,” পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মুখপাত্র ও কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মঙ্গল চাকমা বেনারকে বলেন।
তিনি বলেন, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই কমিশনের জন্য অর্থ বরাদ্দ নেই, কোনো জনবল নেই।
“তাহলে এই কমিশন কাজ করবে কীভাবে? চুক্তি অনুযায়ী ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি নিরোধ আইনটি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে করার কথা। কিন্তু সরকার আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই আইন পাশ করেছে। আর এই আইনে প্রচুর ভুল ছিল,” বলেন মঙ্গল চাকমা।
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি জুয়েল চাকমা বেনারকে বলেন, যে ভূমিকে কেন্দ্র করে চুক্তি হলো, সে ভূমির ব্যাপারে সরকার কিছুই করেনি।
“কথা ছিল আঞ্চলিক পরিষদের অনুমোদন ছাড়া কোনো জমি ইজারা দেওয়া যাবে না। কিন্তু তা হয়নি। নব্বই হাজার একরের ওপর জমি বেসরকারি সংস্থাকে দেওয়া হয়েছে। এসব ব্যাপারে কখনো আদিবাসীদের মতামত নেওয়া হয়নি,” জুয়েল চাকমা বলছিলেন। আদিবাসীদের ভূমি নিয়ে রাস্তাঘাট, হোটেল–রিসোর্ট করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলছিলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের যে অভিযোগ তারও সুরাহা হচ্ছে না। এ বছর রমেন চাকমা নামে এক ব্যক্তির মৃত্যুর জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়ী করা হচ্ছে। কিন্তু তার পরিবার সুবিচার পায়নি।
‘সব চুক্তি বাস্তবায়িত হবে’
সরকার অবশ্য দাবি করছে ধারাবাহিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাসদস্যদের প্রত্যাহার করা হচ্ছে। গত বছর জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, পার্বত্য এলাকায় ২৩২ টি অস্থায়ী সেনাক্যাম্প ছিল, ১১৯টি সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে।
এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের অ–আদিবাসী বাসিন্দারা মনে করছেন, ভূমি থেকে তাঁদের অধিকার পুরোপুরি রহিত করাটা অন্যায়। বান্দরবান কলেজে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন আবু তাহের। তিনি বলছিলেন, সব পক্ষের স্বার্থই দেখা উচিত।
“দেখুন, চুক্তির বাস্তবায়ন জরুরি, সেটা আমিও মনে করি। তবে পাহাড়ি–বাঙালি দু পক্ষের ভালোর কথাই চিন্তা করা দরকার। ভূমি ইজারা না দিলে সড়কপথগুলো তৈরি হতো না, বিদেশি বিনিয়োগ হতো না, পর্যটকেরা আসতে পারতেন না। একেবারে চুক্তি না থাকার চেয়ে, চুক্তি হওয়াটা ভালো হয়েছে,” আবু তাহের বেনারকে বলেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈ সিং মঙ্গলবারে বেনারকে বলেন, “দেখুন সরকারের বিরুদ্ধে সন্তু লারমাদের অভিযোগ যে আমরা শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক নই। আমরা যদি আন্তরিক না হতাম হলে তাহলে এতগুলো বিভাগ কীভাবে হস্তান্তর করা হলো? শুধু অভিযোগ করে কোনো সমাধান হয় না। সরকার শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে বদ্ধ পরিকর। সব চুক্তি বাস্তবায়িত হবে।”
এক প্রশ্নের জবাবে বীর বাহাদুর বলেন, পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যানের মেয়াদ তিন বছর বাড়ানো হয়েছে। সুতরাং, কাজ চলছে।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে অগ্রগতির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে।