বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড: মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সাজা কমায় তীব্র প্রতিক্রিয়া

জেসমিন পাপড়ি
2017.08.07
ঢাকা
রায় ঘোষণার আগে বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার আসামিদের আদালতে হাজির করা হয় রায় ঘোষণার আগে বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার আসামিদের আদালতে হাজির করা হয়। ডিসেম্বর ১৮, ২০১৩।
নিউজরুম ফটো

বাংলাদেশে বহুল আলোচিত বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের ছবি এবং ভিডিওচিত্রে অস্ত্রসহ দৃশ্যমান আসামিরা ছাড় পাওয়ায় রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিহতের স্বজন ও আইনজ্ঞরা।

যদিও এ ঘটনার জন্য তদন্তের দুর্বলতাকে দায়ী করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। তবে আইনজ্ঞরা দুষছেন বিচার ব্যবস্থার ‘গাফিলতি’ আর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাবকে। এমনকি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের বিরুদ্ধে প্রমাণ নষ্ট করার অভিযোগ তুলেছেন তাঁরা।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল হালিম বেনারকে বলেন, “বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় যেখানে ভিডিও ফুটেজ জ্বলন্ত প্রমাণ, সেখানে এই ভিডিওগুলো সংগ্রহ করা এবং নতুন করে তদন্ত করার নির্দেশ না দেওয়া বিচার বিভাগের একটা গাফিলতি।”

গত রোববার পুরান ঢাকার দর্জি বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আট আসামির চারজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং দুজনকে খালাস দেয় উচ্চ আদালত। এ মামলায় ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আসামিদের আপিলের ওপর শুনানি শেষে এ রায় ঘোষণা করা হয়।

পাঁচ বছর আগের আলোচিত এ মামলার রায়ে দুজনের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখা হয়েছে। এ ছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া ১৩ আসামির মধ্যে আপিলকারী দুজনকেও খালাস দেওয়া হয়েছে। আসামিরা সকলেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন।

রায়ের পর্যবেক্ষণে দেশের ছাত্র রাজনীতি দূষিত হয়ে পড়েছে বলেও মন্তব্য করেছে উচ্চ আদালত। এর পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপরের সারির নেতাদের দায়ী করা হয়েছে।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মনিরুজ্জামান সাংবাদিকেদর বলেন, “আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, ভিডিও ফুটেজ, অপরাধের ধরন ও গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল ও চারজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। সন্দেহাতীতভাবে চারজনের অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় তাঁরা খালাস পেয়েছেন।”

বিশ্বজিৎ দাসকে হত্যার এমনই সব চিত্র ধরা পড়ে গণমাধ্যমের ক্যামেরায়। ডিসেম্বর ০৯, ২০১২
বিশ্বজিৎ দাসকে হত্যার এমনই সব চিত্র ধরা পড়ে গণমাধ্যমের ক্যামেরায়। ডিসেম্বর ০৯, ২০১২
নিউজরুম ফটো
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে সকালে পথচারী বিশ্বজিৎ দাসকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়। বেশ কিছু টেলিভিশনের ক্যামেরায় সরাসরি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা রেকর্ড হয়। পরের বছর ১৮ ডিসেম্বর দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী ওই হত্যা মামলায় রায়ে ২১ আসামির মধ্যে ৮ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪।

হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা আসামিরা হলেন রফিকুল ইসলাম ওরফে শাকিল ও রাজন তালুকদার (পলাতক)। মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছেন মাহফুজুর রহমান ওরফে নাহিদ, রাশেদুজ্জামান ওরফে শাওন, ইমদাদুল হক ও নূরে আলম (পলাতক) লিমন। এছাড়া নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া যে দুজন খালাস পেয়েছেন তারা হলেন সাইফুল ইসলাম ও কাইয়ুম মিয়া।

নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আসামির মধ্যে খালাস পেয়েছেন এইচ এম কিবরিয়া ও গোলাম মোস্তফা। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া বাকি ১১ আসামির সবাই পলাতক হলেও তাঁদের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি হাইকোর্ট।

মিল নেই ময়নাতদন্ত ও সুরতহাল প্রতিবেদনে

উচ্চ আদালত সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের মধ্যে বিস্তর অমিল খুঁজে পেয়েছে। এ কারণে রায়ে পুলিশ ও চিকিৎসকের কোনো গাফিলতি ছিল কি না, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তা তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই নির্দেশনার বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা ও তা আদালতকে জানানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আইনজীবী মনজিল মোরসেদকে।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মনিরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, “বিশ্বজিতের লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে একটি গুরুতর আঘাতের কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, সাক্ষ্য, ভিডিও ফুটেজ এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট পর্যালোচনা করে ওই প্রতিবেদন দুটি আদালতের কাছে অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়েছে।”

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান মনে করেন, “বিশ্বজিৎ হত্যার ভিডিও-ফুটেজ এমন সাক্ষ্য প্রমাণ যা নতুন করে প্রমাণ করার কিছু নেই।”

তিনি বেনারকে বলেন, “দিনে দুপুরে সকলের সামনে যে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, এমন চাঞ্চল্যকর মামলায় আদালতের কাছ থেকে ‘তদন্ত সংস্থা দুর্বল’ কেবলমাত্র এমন দোষারোপ বা পর্যবেক্ষণ আমরা আশা করি না। তদন্ত সংস্থা কোনো গাফিলতি করে থাকলে, যাদের শনাক্ত করে নাম উল্লেখ করা দরকার সেগুলো না করে থাকলে, আদালত আরেকটু সক্রিয় হয়ে এই দুর্বল তদন্ত প্রত্যাখ্যান করতে পারত।”

দূষিত ছাত্র রাজনীতি

এখনকার ছাত্র রাজনীতি জৌলুশ হারিয়ে দূষিত হয়ে পড়েছে বলে রায়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে উচ্চ আদালত।

“আর এতে করে কিছু বিপথগামী তরুণ চাঁদাবাজি, অস্ত্র-মাদক ব্যবসা, খুন, রক্তারক্তিতে জড়িয়ে পড়েছে। যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে ওপরের সারির কিছু নেতা,” রায়ে বলা হয়।

আদালত মনে করে, এসব সমস্যার সমাধান করা জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের দায়িত্ব; তারা ক্ষমতায় বা বিরোধী দলে যেখানেই থাকুক।

আইনজীবী আবদুল হালিম বেনারকে বলেন, “আসামিরা ছাত্রলীগের ছত্র ছায়ায় ছিল। তারা নিরপেক্ষ সাক্ষীদের আদালতে আসতে দেয়নি। রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করা প্রসিকিউশনের সদস্যরাও দলীয়ভাবে নির্বাচিত হওয়ায় তাঁরাও আসামিদের শেল্টার দিয়েছে, প্রমাণাদি নষ্ট করেছে। যার ফলে মামলা সঠিকভাবে প্রমাণ করা যায়নি।”

রায় প্রত্যাখ্যান পরিবারের

উচ্চ আদালতের দেওয়া রায় প্রত্যাখ্যান করেছেন নিহত বিশ্বজিৎ দাসের পরিবার।

হতাশা ব্যক্ত করে বাবা অনন্ত দাস বেনারকে বলেন, “দিনের আলোয় সকলের সামনে ১০-১২ জন মানুষ ওকে (বিশ্বজিৎ) দানবের মতো কুপিয়ে মারল। কারা মারল সেই দৃশ্য টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে সবাই দেখল। শুধু আদালত দেখতে পেল না।”

তিনি বলেন, “উচ্চ আদালত থেকে চিহ্নিত আসামিরা খালাস পায় কীভাবে? এই বিচার মানি না। আমরা বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি চাই।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।