যুদ্ধাপরাধ মামলায় সাবেক সাংসদের ফাঁসি,ছয় জনের আমৃত্যু কারাদণ্ড

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.08.10
20160810-BD-Tribunal1000.jpg মানবতাবিরোধী অপরাধে সাবেক সাংসদ সাখাওয়াত হোসেনসহ আটজনের রায় ঘোষণা উপলক্ষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। আগস্ট ১০, ২০১৬।
ফোকাস বাংলা

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাবেক সাংসদ সাখাওয়াত হোসেনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া আরও সাতজনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত রায় হওয়া ২৬টি মামলার ৪৪ জন আসামির মধ্যে ২৭ যুদ্ধাপরাধীকে সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ন্যায় বিচারের ইতিহাস গড়ছে বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের। এ ছাড়া এর মাধ্যমে একাত্তরের শহীদদের রক্তের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ হচ্ছে বলেও মনে করেন তাঁরা।

সাবেক সাংসদের মৃত্যুদণ্ড

১৯৭১-এ যশোরের কেশবপুরে বিভিন্ন গ্রামে মানবতাবিরোধী অপরাধ করার দায়ে সাবেক সংসদ সদস্য সাখাওয়াত হোসেনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।একইসঙ্গে সাতজনকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।

বুধবার বিচারপতি আনোয়ারুল হক নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই রায় ঘোষণা করে। আসামিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা পাঁচ অভিযোগের সবগুলোই প্রমাণিত হয়েছে বলে ৭৬৮ পৃষ্ঠার রায়ের সার সংক্ষেপ জানায় আদালত।

সাবেক সাংসদ সাখাওয়াত ছাড়া এ মামলার বাকি আসামিরা হলেন; মো. ইব্রাহিম হোসাইন, মো. বিল্লাল হোসেন বিশ্বাস, শেখ মো. মজিবুর রহমান, আব্দুল আজিজ সরদার, কাজী ওহিদুল ইসলাম, এম এ আজিজ সরদার ও মো. আব্দুল খালেক।

তাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় অপহরণ, আটক, নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার মতো পাঁচ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। রায়ের সময় জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাখাওয়াত হোসেন ও বিল্লাল হোসেন কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। বাকি ছয় আসামিকে পলাতক দেখিয়েই এ মামলার বিচার কার্য চালানো হয়।

এর আগে এ মামলায় মো. লুৎফর মোড়ল নামের আরেকজন আসামি ছিলেন। অসুস্থ হয়ে কারাগারে মারা গেলে তার নাম  মামলা থেকে বাদ দেওয়া হয়।

অভিযোগ ও সাজা সমূহ

এক নম্বর অভিযোগে বলা হয়, যশোরের কেশবপুর উপজেলার বোগা গ্রামে এক নারীকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন এবং ধর্ষণ করে আসামি সাখাওয়াত হোসেন, মো. ইব্রাহিম হোসাইন, এম এ আজিজ সরদার ও আব্দুল আজিজ সরদার। এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আসামিদের ২০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেয় আদালত।

দুই নম্বর অভিযোগে একই উপজেলার চিংড়া গ্রামের চাঁদতুল্য গাজী ও তাঁর ছেলে আতিয়ারকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ ছিল উপরোক্ত আসামিরা ছাড়াও মো. বিল্লাল হোসেন বিশ্বাস, শেখ মো. মজিবুর রহমান, কাজী ওহিদুল ইসলাম ও মো. আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে। এ অভিযোগে সাখাওয়াতকে মৃত্যুদণ্ড ও বাকিদের আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আদালত।

সাখাওয়াত হোসেন, শেখ মো. মজিবুর রহমান, মো. ইব্রাহিম হোসাইন ও মো. আব্দুল খালেক মোড়লের বিরুদ্ধে কেশবপুরের চিংড়া গ্রামের মো. নুরুদ্দিন মোড়লকে অপহরণ, আটক, নির্যাতনের অভিযোগে ছিল। তিন নম্বর এই অভিযোগ থেকে মো. ইব্রাহিম হোসাইন খালাস পেলেও বাকিদের ১০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

কেশবপুরের হিজলডাঙার আ. মালেক সরদারকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও খুনের অভিযোগ ছিল সাখাওয়াত, ইব্রাহিম, এম এ আজিজ, আব্দুল আজিজ ও আব্দুল খালেক মোড়লের বিরুদ্ধে। এ অভিযোগে সাখাওয়াতকে মৃত্যুদণ্ড ও বাকিদের আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আদালত।

উপরোক্ত পাঁচ আসামিকে কেশবপুরের মহাদেবপুর গ্রামের মিরন শেখকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন এবং ওই গ্রামে অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের অভিযোগে ১৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

কে এই সাখাওয়াত?

মামলার অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, সাখাওয়াতসহ এ মামলার ষাটোর্ধ্ব বয়সের আসামিরা একাত্তর সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। বর্তমানে জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও সাখাওয়াত ছিলেন তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্য। যে সংগঠনের কর্মীদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল আল বদর বাহিনী।

সাবেক সাংসদ সাখাওয়াত হোসেন। ফাইল ফটোঃ বাসস।

বাকিরা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন। তারা যশোরের কেশবপুরে হত্যা, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয়।

১৯৯১ সালে যশোর-৬ আসন থেকে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন এই যুদ্ধাপরাধী। পরে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ১৯৯৬ সালে আবারও একই আসনে নির্বাচিত হন তিনি।

পরে এলডিপি ও পিডিপি ঘুরে ২০০৮ সালে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন সাখাওয়াত। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও যশোরের ওই আসন থেকে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন সংগ্রহ করেন তিনি।

আপিল করবে আসামিপক্ষ

এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ।এ প্রসঙ্গে প্রসিকিউটর রেজিয়া সুলতানা চমন বেনারকে বলেন,“দীর্ঘদিন পরে হলেও যশোরের কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্য দিয়ে জাতি স্বস্তি পেল। রায়ে আমরা অত্যন্ত খুশি।”

তবে এ রায়ে অসন্তোষ জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলে জানিয়েছে তারা।

এ বিষয়ে সাখাওয়াতের আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান বেনারকে বলেন, “আমরা এ রায়ে মোটেই সন্তুষ্ট নই। আমরা ন্যায় বিচার বঞ্চিত। আমরা সংক্ষুব্ধ।এ রায়ের বিরুদ্ধে অবশ্যই আপিল করব। আশা করি উচ্চ আদালত থেকে আসামিরা মুক্তি পাবেন।”

নিয়ম অনুযায়ী, ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিত আসামিরা এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পাবেন। তবে এ সুযোগ নিতে হলে পলাতকদের আত্মসমর্পণ করতে হবে।

ছোট-বড় সকল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রত্যাশা

সাখাওয়াতসহ আটজন যুদ্ধাপরাধীর বিচারে সন্তোষ প্রকাশ করার পাশাপাশি দেশের আনাচে কানাচের সকল যুদ্ধাপরাধীরা চলমান বিচার প্রক্রিয়ার আওতায় আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদ বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট বড় সব রাজাকারের বিচার হবে আগামীতে। হয়তো আমি থাকব না তারপরও বাংলাদেশ একটি রাজাকারমুক্ত দেশ হবে, সেই বিশ্বাস নিয়ে স্বস্তিতে থাকব।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।