মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে চার জনের মৃত্যুদণ্ড
2018.07.17
ঢাকা

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে চার ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মৌলভীবাজার জেলার রাজনগরে ১৯৭১ সালে ৬১ জনকে হত্যা ও ছয়জনকে ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকার দায়ে তাঁদের এই শাস্তি দেওয়া হয়।
বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মঙ্গলবার সকালে এ রায় দেন। রায়ে বলা হয়েছে, “আসামিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা দুটি অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে।”
রায় ঘোষণার সময় আসামি আকমল আলী তালুকদার (৭৯) কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। বাকি তিন আসামি আব্দুন নূর তালুকদার ওরফে লাল মিয়া (৬৬), আনিছ মিয়া (৮০) ও আব্দুল মোছাব্বির মিয়া (৬৭) পলাতক রয়েছেন। আদালত চার আসামিকে মৃত্যু পর্যন্ত ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে সাজা কার্যকর করার নির্দেশনা দিয়েছে।
মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হায়দার আলী বেনারকে বলেন, “নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের মামলায় রায়ের এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করা যায়। তবে পলাতক আসামিদের সে সুযোগ নিতে হলে আত্মসমর্পণ করতে হবে।”
প্রসঙ্গত, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংঘটিত আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ যাত্রা শুরু করা এই ট্রাইব্যুনাল এখন পর্যন্ত ৪৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। এই সময়ে ৩৩টি রায়ে মোট ৭৩ ‘যুদ্ধাপরাধীর’ সাজা হয়েছে।
এ ছাড়া বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছেন পাঁচ আসামি ।
ট্রাইব্যুনালের মঙ্গলবারের রায়ে একটি অভিযোগে চার আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড এবং অন্য অভিযোগে সবাইকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়। হায়দার জানান, অভিযোগ দুটির একটি ছিল ৫৯ জনকে হত্যা, ছয়জনকে ধর্ষণ এবং ৮১টি বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা। আরেকটি ছিল চক্রবর্তী পরিবারের দুজনকে হত্যার।
“আমরা দুটি অভিযোগই প্রমাণ করেছি। তাই প্রথম অভিযোগে চার আসামিকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া দুজনকে হত্যার অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল,” বেনারকে বলেন এই প্রসিকিউটর।
রায়ে পলাতক তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করে সাজা কার্যকর করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আসামিদের বিচারের মুখোমুখি করতে ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে লাল মিয়া, আনিছ ও মোছাব্বির পালিয়ে যান। তাঁরা জামায়াতে ইসলামীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন বলেও জানান হায়দার।
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে। এই প্রতিবেদনে আসামিদের বিরুদ্ধে ১০২টি পরিবারের ঘরবাড়ি লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ এবং সাতজনকে অপহরণের অভিযোগ আনা হয়।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পর গত বছরের ৭ মে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল। এরই ধারাবাহিকতায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয় ৪ জুলাই। পরের মাসেই হামলার শিকার হন রাষ্ট্রপক্ষের অন্যতম সাক্ষী পাঁচগাঁও গ্রামের বারীন্দ্র মালাকার।
মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ১৩ জন সাক্ষীর মধ্যে পাঁচজনই একাত্তরে আসামিদের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ক্ষতির শিকার হয়েছিলেন। হায়দারের শঙ্কা, “এই রায়ের পরও তাঁদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা হতে পারে।”
প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে গত ২৭ মার্চ মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়। রাষ্ট্রপক্ষে প্রসিকিউটর হায়দার আলীর সঙ্গে ছিলেন শেখ মুশফিক কবীর। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন আব্দুস সোবহান তরফদার। পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী ছিলেন আবুল হোসেন।
আসামিরা রাজকার ছিলেন
আদালতের নথিতে বলা হয়েছে, চার আসামি একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করে গঠিত রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন। এর মধ্যে মৌলভীবাজার টাউন সিনিয়র কামিল মাদ্রাসার অবসরপ্রাপ্ত উপাধ্যক্ষ আকমল আলী পাঁচগাঁও ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন।
আব্দুন নূর তালুকদার ওরফে লাল মিয়া মুসলিম লীগের রাজনীতি সঙ্গে জড়িত ছিলেন।