আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে কৌঁসুলি তুরিনকে অপসারণ
2019.11.11
ঢাকা

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কৌঁসুলি তুরিন আফরোজকে ‘শৃঙ্খলাভঙ্গ’ ও ‘গুরুতর অসদাচরণের’ দায়ে অপসারণ করেছে সরকার। সোমবার আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাঁকে অপসারণের খবর প্রকাশ করে।
ওই প্রজ্ঞাপনে ‘শৃঙ্খলাভঙ্গ’ ও ‘গুরুতর অসদাচরণ’ বলতে তুরিন আফরোজের কোন অপরাধের কথা বলা হচ্ছে সে সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়নি।
বেনার নিউজকে তুরিন আফরোজ বলেন, “আমি সরকারের সিদ্ধান্ত আদালতে চ্যালেঞ্জ করার কথা ভাবছি।”
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, তুরিন আফরোজকে যে মামলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সে মামলার আসামির সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ ও তথ্য ফাঁসের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সম্পর্কিত অডিও–ভিডিও রয়েছে। এগুলো পর্যালোচনা করে তুরিন আফরোজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, তুরিন আফরোজের সঙ্গে আসামিপক্ষের কথা হয়েছে। এ–সংক্রান্ত রেকর্ড রয়েছে।
আইনমন্ত্রী তাঁর অপসারণকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন। কেন তুরিনের ‘সেন্স অব জাজমেন্ট’ কাজ করল না তা নিয়েও হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।
“দেখুন আমি সরকারের এই সিদ্ধান্তে মর্মাহত। শৃঙ্খলাভঙ্গ ও গুরুতর অসদাচরণ বলতে মন্ত্রণালয় কী বোঝাতে চেয়েছে তা পরিষ্কার নয়। আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি,” বেনারকে বলেন তুরিন আফরোজ।
তিনি বলেন, “আমি আদালতে এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করার কথা ভাবছি।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তুরিন আফরোজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কৌঁসুলি হিসেবে নিয়োগ পান ২০১৩ সালে।
যে অভিযোগ উঠেছিল
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কৌঁসুলি তুরিন আফরোজের বিরুদ্ধে মোট তিনটি অভিযোগের তদন্ত হচ্ছিল। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক (অব.) ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ, মামলার নথি ফাঁস ও মামলার মেরিট নিয়ে কথা বলা।
তুরিন আফরোজ গত বছরের ১১ নভেম্বর ওয়াহিদুল হকের বিরুদ্ধে ওঠা মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলার দায়িত্ব পান। ওয়াহিদুল এ বছরের ২৪ এপ্রিল গ্রেপ্তার হন। তিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন।
জানা গেছে, ওয়াহিদুল হক গ্রেপ্তার হওয়ার পর গুলশান থানা-পুলিশ তাঁর মুঠোফোন জব্দ করে। ওই মুঠোফোনের অডিও রেকর্ডগুলো পরীক্ষা করতে গিয়ে তুরিন আফরোজের সঙ্গে কথোপকথনের তথ্য পায় পুলিশ। পরে পুলিশ বিষয়টি ট্রাইব্যুনালকে জানায়।
এরপর সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি ফাঁস হয়। এতে বলা হয়, তুরিন আফরোজ গত বছরের ১৮ নভেম্বর ওয়াহিদুল হককে ফোন করে দেখা করতে চান। তিনি ওয়াহিদুলকে তাঁর মামলা সম্পর্কে অবহিত করেন। তিনি আরও বলেন, দেখা না করলে ওয়াহিদুলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হবে। পরে তাঁরা ঢাকার অলিভ গার্ডেন নামে একটি রেস্তোরাঁয় দেখা করেন। ওই বৈঠকে তুরিন ছাড়াও তাঁর সহকারী ফারাবিসহ মোট পাঁচজন উপস্থিত ছিলেন।
অভিযোগ ওঠার পর থেকে তুরিন আফরোজ মামলার কার্যক্রম থেকে বিরত থাকেন।
ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ টিপু এ সম্পর্কিত দুটি অডিও রেকর্ড ট্রাইব্যুনাল আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে জমা দেন। এ বছরের ১০ মে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আইন মন্ত্রণালয় তদন্ত করছে। তিনি দোষী হলে অবশ্যই তাঁর বিচার হবে।”
আইনমন্ত্রী যা বললেন
গতকাল সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, তুরিন আফরোজকে অব্যাহতি দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছিল। তবে কাজটা তিনি ‘খুশি’ হয়ে করেননি।
“কাজটা যে আমি খুশি হয়ে করেছি, তা না। কিন্তু তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। কারণ যে মামলা নিয়ে কথা হচ্ছে, সেটির চার্জগঠন হয়ে গেছে। সে কারণে এই ব্যাপারটির নিষ্পত্তি টানা দরকার ছিল,” আনিসুল হক বলেন।
তবে যে কারণে তুরিনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, তার আগে পর্যন্ত তুরিন নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন বলেও মন্তব্য করেছেন আনিসুল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়নি
যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে ট্রাইব্যুনালের কৌঁসুলিদের দক্ষতা এবং বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক বেশ কিছু গণমাধ্যম প্রশ্ন তোলে। নতুন করে তুরিন আফরোজ প্রসঙ্গ কি ট্রাইব্যুনালকে চাপে ফেলল?
কথা হচ্ছিল একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে। তুরিন আফরোজ ২০১০ সাল থেকে এ কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক পদে কাজ করছেন।
“তুরিনের দক্ষতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। সে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছে। আমি মনে করি না তুরিন আফরোজের কারণে ট্রাইব্যুনাল কোনো ভাবমূর্তি সংকটে পড়বে,” শাহরিয়ার কবির বেনারকে বলেন।
শাহরিয়ার কবির আরও জানান, অভিযোগ ওঠার পর তিনজন সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে কমিটি করা হয়। ওই কমিটি এ ঘটনায় তুরিনের আর্থিক লেনদেনের অভিযোগের প্রমাণ পায়নি। তুরিন কমিটিকে জানিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল আইন মামলা পরিচালনার পাশাপাশি তদন্তের ক্ষমতা তাঁকে দিয়েছে। তাই তিনি তদন্তের স্বার্থে আসামির সঙ্গে দেখা করেন।