ঢাকার পর গাজীপুরেও বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে চীনা কোম্পানী

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.12.08
ঢাকা
ঢাকার পর গাজীপুরেও বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে চীনা কোম্পানী ঢাকার আমিন বাজার ল্যান্ডফিলে আবর্জনার মধ্যে কাজ করছেন সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। এমন আবর্জনা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আমিনবাজার এলাকায় একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করছে চীনা কোম্পানী। ১৩ জুলাই, ২০২০ ।
বেনার নিউজ

দেশে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য চীনা কোম্পানিকে গাজীপুরে আরেকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে সরকার। এর আগে গত বছরের নভেম্বরে ঢাকায় একই ধরনের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, সেটির অনুমতিও পেয়েছিল চীন।

বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামালের সভাপতিত্বে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় বর্জ্যভিত্তিক দ্বিতীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানান অর্থ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা গাজী তৌহিদুল ইসলাম।

গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকার কাউলতিয়ায় দৈনিক সাড়ে ৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য চীনা কোম্পানি ক্যানভেস এনভায়রনমেন্টাল ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি সেখানে একটি কেন্দ্র স্থাপন করবে।

ঢাকা শহরের অদূরে আমিনবাজারে দেশের প্রথম বর্জ্যভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করছে চীনা কোম্পানি চায়না মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন।

এর ফলে দেশের দুটি বর্জ্যভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রই স্থাপন করছে চীনা কোম্পানি।

জ্বালানী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরে এসে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। চীনা কোম্পানিগুলো এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগে বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কার্যপত্র অনুযায়ী, ১৪ হাজার ৪০৮ কোটি টাকার (এক দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার) বেশি অর্থ ব্যয়ে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে এই বিদ্যুকেন্দ্র স্থাপন হবে। প্রকল্পে সরকার কোনও বিনিয়োগ করবে না।

মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো: সামসুল আরেফিন বেনারকে বলেন, “এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে সরকারের কোনও খরচ হবে না। পুরো বিনিয়োগ করবে ক্যানভেস। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড চীনা কেন্দ্রের কাছ থেকে ‍শুধু বিদ্যুৎ কিনবে। এই চুক্তির মেয়াদ ২৫ বছর। তবে চীনা প্রতিষ্ঠান যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন না করতে পারে, তবে তাদের কোনও অর্থ দেয়া হবে না।”

তিনি বলেন, প্রতি কিলোওয়াট ঘন্টা বিদ্যুৎ কিনতে সরকারের খরচ হবে ১৭ টাকা কুড়ি পয়সা (শুণ্য দশমিক ২১৫ মার্কিন ডলার)।

আরেফিন বলেন, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করতে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সাথে চুক্তি করবে চীনা কোম্পানী। কারণ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বর্জ্য সরবরাহ নিশ্চিত করবে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন।

এ ছাড়া অনুমোদনের পরবর্তী পদক্ষেপ অনুসারে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করতে চুক্তি স্বাক্ষর করবে বিদ্যুৎ বিভাগ, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন ও ক্যানভেস।

অতিরিক্ত সচিব আরেফিন বলেন, খুব নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও খুব তাড়াতাড়ি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শুরু হবে বলে আশা করা যায়।

চীনা এই বিনিয়োগের ব্যাপারে মন্তব্য জানতে ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসে ই-মেইল পাঠানো হলেও কোন জবাব পাওয়া যায়নি।

গত বছর নভেম্বরে ঢাকার আমিনবাজার ডাম্পিং স্টেশনকে কেন্দ্র করে একটি বর্জ্যভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য চীনা কোম্পানি চায়না মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশনকে (সিএমইসি) অনুমতি দেয় সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি।

এটিই বর্জ্য থেকে প্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ। সেই অনুমোদন অনুযায়ী, এ বছর পহেলা ডিসেম্বর সিএমইসি এর সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে বিদ্যুৎ বিভাগ ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন।

চুক্তি অনুযায়ী আগামী দুই বছরের মধ্যে আমিনবাজারের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ শেষ হবে। ৪২ দশমিক ৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এই কেন্দ্রটি নির্মাণে ব্যয় হবে ১৫ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের দাম পড়বে ১৮ দশমিক ২৯৫ টাকা।

দেশের বৃহত্তম শহর ঢাকা মহানগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিক নয়। গৃহস্থালি থেকে শুরু করে প্রায় সকল বর্জ্য একসাথে বাসাবাড়ি থেকে সংগ্রহ করে সিটি কর্পোরেশনের নিয়োগ করা বেসরকারি কোম্পানি।

এই বর্জ্য মাতুয়াইল এবং আমিনবাজারে ফেলা হয়।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. জিয়াউল হক বেনারকে বলেন, “ঢাকাসহ সকল শহরাঞ্চলের বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেলে একদিকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার যেমন উন্নয়ন ঘটবে, তেমনি আমরা এখান থেকে পরিস্কার বিদ্যুৎ পাবো।”

তিনি বলেন, “এই বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেলে আমিনবাজার এবং মাতুয়াইল ল্যান্ডফিল থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী মিথেন গ্যাস নি:সরণ বন্ধ হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ও সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা ম. তামিম বেনারকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বে কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশও ১০টি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল করে দিয়েছে।

তিনি বলেন, “এখন সবাই নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং পরিস্কার বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে যাচ্ছে। বর্জ্য থেকে যে বিদ্যুৎ হয় সেটিকে ক্লিন বিদ্যুৎ বলা হয়। আমাদের এখানে যে বর্জ্য উৎপাদন হয় সেটির সঠিক ব্যবস্থাপনা হয় না। বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেলে সেটি ভালো কাজে লাগবে।”

অধ্যাপক তামিম বলেন, “অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও চীনারা বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রকল্প শুরু করছে। দেশে যে দুটি বর্জ্য ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র করা হচ্ছে সেগুলোর সবই চীনা বিনিয়োগ।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের কয়লাভিত্তিক প্রায় সব বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়ন করছে চীনারা। তারা সৌর বিদ্যুৎ এবং বর্জ্য বিদ্যুৎ দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। সুতরাং, চীনারা বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের বড় অংশীদার হতে যাচ্ছে, এটা স্পষ্ট।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।