চিকিৎসা নৈরাজ্য রোধে পশ্চিমবঙ্গে কড়া আইন

পরিতোষ পাল
2017.03.03
কলকাতা
চিকিৎসা গাফিলতি ও অতিরিক্ত বিলে ক্ষুব্ধ হয়ে হাসপাতাল ভাঙচুর। চিকিৎসা গাফিলতি ও অতিরিক্ত বিলে ক্ষুব্ধ হয়ে হাসপাতাল ভাঙচুর। ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, কলকাতা।
বেনার নিউজ

পশ্চিমবঙ্গে বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিং হোমগুলোর বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বিল নেওয়ার অভিযোগ বহু পুরোনো। এ ছাড়া আছে বিনা কারণে ভেন্টিলেশনে রাখা, অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা করানো, এমনকি লাইফ সাপোর্টে থাকা রোগীকে অস্ত্রোপচার করার নামে অর্থ নেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ।

এই অবস্থার লাগাম টানতে গতকাল শুক্রবার বিধানসভায় পাশ হয়ে গেল ক্লিনিক্যাল এসটাবলিশমেন্ট বিল। শুধুমাত্র বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি, নিয়ন্ত্রণ ও স্বচ্ছতা বজায় রাখার লক্ষ্য নিয়ে ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্লিনিক্যাল এসটাবলিশমেন্ট (রেজিস্ট্রেশন, রেগুলেশন অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি) বিল ২০১৭ পাশ হয়।

সরকার কণ্ঠভোটে পাশ করিয়ে নিয়েছে বিলটি। বিরোধীরা বিলকে সমর্থন জানায়নি। তবে প্রস্তাবের বিপক্ষেও তাঁরা ভোট দেয়নি।

লাগাম টানতে কড়া আইন

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে দুই হাজার ৮৮টি বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোম রয়েছে। এর মধ্যে কলকাতাতেই রয়েছে ৩৭০টি।

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৯৪২টি বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমে তদন্ত করে নানা গাফিলতির অভিযোগে ৩৭টির লাইসেন্স বাতিল করেছে। আর কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়েছে ৭০টি প্রতিষ্ঠানকে।

নতুন আইনে চিকিৎসায় গাফিলতি বা অবহেলার অভিযোগ প্রমাণ হলে হাসপাতাল ছয় মাসের মধ্যে রোগীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে। চিকিৎসায় অনিয়ম বা গাফিলতির কারণে রোগীর সামান্য ক্ষতি হলে তিন লাখ রুপি পর্যন্ত জরিমানা, বড় ক্ষতি হলে পাঁচ লাখ রুপি পর্যন্ত জরিমানা এবং রোগীর মৃত্যু হলে ১০ লাখ রুপি জরিমানা হবে ।

এই আইনের আওতায় গঠন করা হবে ওয়েস্ট বেঙ্গল হেলথ রেগুলেটরি কমিশন। সমস্ত অভিযোগ খতিয়ে দেখবে কমিশন।

হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বা সাবেক মুখ্যসচিব কিংবা অতিরিক্ত মুখ্যসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের এই কমিশন কাজ করবে।

নতুন আইনে বলা হয়েছে, জরুরি চিকিৎসা অর্থের জন্য আটকে রাখা যাবে না। তেমনি বিল বকেয়া থাকলেও মৃতদেহ আটকে রাখা যাবে না। চিকিৎ​সা সেবায় স্বচ্ছতা আনতে ই-প্রেসক্রিপশন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।

বিধান সভায় শুক্রবার বিলটি পেশ করার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এটি ঐতিহাসিক বিল, সারা দেশের কাছে এই বিল মডেল হয়ে উঠবে।’’

যদিও সরকারি হাসপাতালগুলোকে এই বিলের আওতায় আনা হয়নি। এ নিয়ে বিরোধী দলগুলোর সমালোচনার জবাবে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবায় বিপুল উন্নতি হলেও বিরোধীরা তা দেখতে পান না।

বিরোধী সিপিআইএম দলের পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, “সরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করুক সেটা আমরাও চাই। তবে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতি প্রয়োজন।”

এর আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি একটি বেসরকারি হাসপাতালের উদ্বোধনকালে বলেছেন, “বেশি লোভ বা দুঃসাহস কোনটিই ভালো নয়।”

তিনি বলেন, “হাসপাতাল কসাইখানা নয়, সেবার জায়গা। ব্যবসা করুন, কিন্তু লাভের লোভে লাগামছাড়া হবেন না।”

সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বেনারকে বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগ সময়োপযোগী ও সাহসী। অনেক দিন ধরে অনাচার চলছিল। আমরা খুবই অসহায় বোধ করছিলাম।”

অ্যাসোসিয়েশন অব হসপিটালস ইন ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট ডা. রূপক বড়ুয়া সাংবাদিকদের বলেন, “করপোরেট হাসপাতালগুলো সেবার মনোভাব নিয়েই কাজ করে। তবে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে চিকিৎসার খরচ বেড়ে যায়।”

করপোরেট হাসপাতালের শোষণ

গত সপ্তাহে কলকাতার অ্যাপোলো গ্লেনিগেলস হাসপাতালে বিলের ধাক্কা সামলাতে না পেরে রোগীকে অন্য হাসপাতালে নিতে দেওয়ার অনুরোধ জানায় স্বজনরা। কিন্তু বিল না মিটিয়ে নেওয়া যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

সাত দিনেই হাসপাতালের বিল হয়েছিল সাত লাখ রুপি। শেষ পর্যন্ত ফিক্সড ডিপোজিটের সার্টিফিকেট ও ব্লাঙ্ক চেক জমা রেখে ছাড়া হলেও দীর্ঘ টালবাহানায় রোগীকে সরকারি হাসপাতালে নিতে দেরি হয়। রাতেই মারা যান তিনি। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রবল হইচই হয়েছে।

হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাচ্ছেন নিহতের স্ত্রী রুবি রায়। ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭।
হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাচ্ছেন নিহতের স্ত্রী রুবি রায়। ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭।
ছবি:বেনার নিউজ
মৃতের স্ত্রী রুবি রায় সেই হাসপাতালের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় অবহেলা, অতিরিক্ত বিল, প্রতারণা প্রভৃতি অভিযোগ জানিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন।

তিনি বেনারকে বলেন, “আমার স্বামী আর ফিরে আসবেন না। তবে আমি চাই অপরাধীদের শাস্তি হোক।”

এদিকে পশ্চিমবঙ্গের ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে গত দেড় বছরে সাতশ’র বেশি চিকিৎসায় গাফিলতি ও প্রতারণার অভিযোগ জমা পড়েছে বলে সাংবাদিকদের জানান ক্রেতা সুরক্ষা মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে।

মেডিকেল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার এথিক্স কমিটির সদস্য এবং রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিলের পেনাল ও এথিক্যাল কমিটির চেয়ারম্যান সুদীপ্ত রায় বেনারকে বলেন, “মিথ্যা বিল করে অর্থ নেওয়া শুধু অনৈতিকই নয়, বেআইনিও।”

বাংলাদেশি রোগীরালোভের শিকার

পশ্চিমবঙ্গের করপোরেট হাসপাতালগুলোতে বাংলাদেশের রোগীরাই বেশি ভিড় জমায় এবং হাসপাতালের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়।

ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের ২০১৫ সালের একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ শ রোগী চিকিৎসার জন্য ভারতে আসেন, যাদের ৯০ শতাংশই কলকাতার করপোরেট হাসপাতালগুলোতে যান।

বেসরকারি হাসপাতালের লোভের শিকার হলেও এসব বিদেশি রোগীরা জানেন না কোথায় অভিযোগ জানাতে হয়।

চট্টগ্রাম থেকে কলকাতায় আসা মফিজুর রহমান হতাশার সঙ্গে বেনারকে বলেছেন, “নির্দিষ্ট অঙ্কের প্যাকেজের কথা জেনে বাবাকে ভর্তি করেছিলাম। এখন নানা অজুহাতে বিল বেড়ে কয়েক লাখ রুপি হয়েছে। সেই অর্থ জোগাড় করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।”

বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার গাফিলতি ও বিপুল অঙ্কের বিল নেওয়ার ক্ষেত্রে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানান কলকাতায় নিযুক্ত বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনার জাকি আহাদ। তাঁর বাবা কলকাতার এক খ্যাতনামা করপোরেট হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, সেখানেই তিনি মারা যান।

বাংলাদেশে চিকিৎসা সেবাকে জবাবদিহির আওতায় আনার জন্য একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ অনেক দিন থেকেই চলমান আছে। বাংলাদেশ আইন কমিশন এ রকম একটি আইনের খসড়া ইতিমধ্যে প্রণয়ন করেছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক শাহ আলম।

“ওই আইনেও চিকিৎসা সেবার জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব আছে,” জানান শাহ আলম।

আইন কমিশনের ওই সদস্য বলেন, “আইনটি চূড়ান্ত করে গত সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশেও চিকিৎসা সেবার জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য একটি কঠোর আইন প্রয়োজন বলে​ও অভিমত দেন ড. শাহ আলম।

তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে পুলক ঘটক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।