পশ্চিমবঙ্গে ভুয়া ডাক্তার ধরতে সব চিকিৎসকের সার্টিফিকেট যাচাই শুরু
2017.06.05
কলকাতা

এক মাসে সাত ভুয়া চিকিৎসক গ্রেফতার ও জাল মেডিক্যাল ডিগ্রি বিক্রির সাথে জড়িত একটি প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়ার পর রাজ্যের সকল চিকিৎসকের সার্টিফিকেট ও রেজিস্ট্রেশন যাচাই শুরু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
“পশ্চিমবঙ্গে প্রায় এক লক্ষ চিকিৎসকের নাম নথিভুক্ত রয়েছে। এই তালিকা খতিয়ে দেখা হচ্ছে,” বেনারকে বলেন মেডিকেল কাউন্সিলের পশ্চিমবঙ্গ শাখার রেজিস্ট্রার মানস চক্রবর্তী।
সিআইডি রাজ্য জুড়ে ভুয়া চিকিৎসক নিয়ে তদন্ত করছে। সিআইডির অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল রাজেশ কুমার ভুয়া চিকিৎসক নিয়ে প্রাথমিক তদন্তের পর গত ১ জুন পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের মহাপরিচালক সুরজিৎ কর পুরকায়স্থের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।
জানতে চাইলে বেনারের কাছে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে সিআইডির পক্ষ থেকে মেডিকেল কাউন্সিলের কাছে সন্দেহভাজন ৫৫০ জন ভুয়া চিকিৎসক সম্পর্কে তথ্য চেয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
“ভুয়ো চিকিৎসকদের বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। সিআইডির তদন্ত শেষ হলেই আসল চিত্রটা পাওয়া যাবে,” বেনারকে বলেন পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য।
উল্লেখ্য, এমবিবিএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসক হিসেবে প্র্যাকটিস করার জন্য রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিল থেকে রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট নেওয়া বাধ্যতামূলক। অথচ ভুয়া চিকিৎসকেরা সকলেই অন্যের রেজিস্ট্রেশন নম্বর জাল করে ব্যবহার করছিল।
চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, “মানুষ চিকিৎসকদের কাছে যান বিশ্বাসের ওপর ভর করে। চিকিৎসকের ডিগ্রি যাচাই করে কেউ দেখাতে যান না।”
তাই ভুয়া চিকিৎসকদের বিষয়টি কঠোর হাতে দমন করা দরকার বলে তিনি মনে করেন।
একের পর এক ভুয়া চিকিৎসক গ্রেফতার
গত মে মাস থেকে এ পর্যন্ত ৭ জন ভুয়া চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন সিআইডির অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল রাজেশ কুমার।
গ্রেপ্তার হওয়া সাতজনের মধ্যে তিনজন রুবি হাসপাতাল, বেলভিউ হাসপাতাল ও কোঠারী সেন্টারে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেছেন। বাকিদের দুজন সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এবং দুজন প্রাইভেট প্র্যাকটিসে যুক্ত ছিলেন।
সোমবার বীরভূমের ময়ূরেশ্বরে চন্দন চক্রবর্তী নামে এক ভুয়া চিকিৎসককে তাঁর দুই সহযোগীসহ গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সে অঞ্জন পাল নাম নিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করত। তার রেজিস্ট্রেশন ও ডিগ্রি সবই ভুয়া বলে সে স্বীকার করেছে।
চলতি মাসের ২ তারিখ জাল এফআরসিএস ডিগ্রিধারী শুভেন্দু ভট্টাচার্যকে গ্রেফতার করা হয়। গত ৪ জুন যে ভুয়া চিকিৎসককে সিআইডি গ্রেফতার করে, তিনি বিকম ডিগ্রিধারী। অজিত তিওয়ারী নামের ওই ভুয়া চিকিৎসক দক্ষিণ কলকাতার নামকরা কোঠারী মেডিকেল সেন্টারে ২১ বছর ধরে জাল এমবিবিএস ডিগ্রি ও জাল রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেটে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছিলেন।
এর আগে মে মাসের প্রথম দিকে স্বাস্থ্য দপ্তরের অভিযোগের ভিত্তিতে উত্তরবঙ্গ থেকে গ্রেপ্তার করা হয় কায়সার আলম ও খুশিনাথকে। এদের মধ্যে কায়সার উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ায় সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এবং খুশিনাথ আলিপুরদুয়ারের মাদারিহাট ব্লকের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কাজ করছিলেন বলে পুলিশ জানিয়েছে।
এরপরেই গ্রেপ্তার করা হয় স্নেহাশীষ চক্রবর্তীকে।
গত ২৭ মে কলকাতা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় নরেন পাণ্ডেকে। নরেন পাণ্ডে কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালের সঙ্গে চিকিৎসক হিসেবে যুক্ত ছিলেন বলে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন।
এরপর ধৃত ভুয়া চিকিৎসকদের জেরা করে তদন্তকারীরা সার্টিফিকেট জালিয়াত চক্রের হদিস পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন।
সিআইডির এক তদন্তকারী অফিসার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে জানিয়েছেন, গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে প্রতারণা, জালিয়াতি, নথি জাল করার অভিযোগে মামলা হয়েছে।
“ভুয়া চিকিৎসকেরা চিকিৎসার নামে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন। ভারতীয় দণ্ডবিধির আওতায় এদের কঠোর শাস্তি দেওয়া দরকার,” বেনারকে বলেন বিশিষ্ট চিকিৎসক সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী।
ডিগ্রি বিক্রির কারখানা
রাজ্যের ভুয়া চিকিৎসকদের প্রায় সকলেই নানাভাবে জাল সার্টিফিকেট জোগাড় করেছিল বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। আর ধৃতদের জেরা করে উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বারাসাতে সিআইডির গোয়েন্দারা হানা দিয়ে অল্টারনেটিভ মেডিকেল কাউন্সিল নামের একটি সংস্থার অফিস থেকে ৫৬০টি জাল ডিগ্রির কাগজপত্র আটক করেছে।
গত তিন দশক ধরে এই সংস্থা থেকে হাজার হাজার কলেজ ছুট ভারতীয় ও বিদেশি ছাত্রদের কাছে অর্থের বিনিময়ে নানা ধরনের ডিগ্রি বিক্রি করা হয়েছে বলে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন।
গত ২৭ মে এই সংস্থার প্রধান রমেশ চন্দ্র বৈদ্যকে(৫২) গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পুলিশ সুত্রে বলা হয়েছে, জেরায় বৈদ্য জানিয়েছে, ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার মতো দেশ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, ইটালি, রাশিয়া, মালয়েশিয়া ও আফ্রিকা থেকে আসাদের কাছে তারা ডিগ্রি বিক্রি করেছে।
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ডিআইজি (অপারেশন) নিশান্ত পারভেজ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এই সংস্থার বিরুদ্ধে আলাদা করে এফআইআর করা হয়েছে।
বেসরকারি হাসপাতালে নজরদারি
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৯৪২টি বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমে তদন্ত করে নানা গাফিলতির অভিযোগে ৩৭টির লাইসেন্স বাতিল করেছে। আর কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়েছে ৭০টি প্রতিষ্ঠানকে।
এছাড়া গত ৩ মার্চ বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ এর লক্ষ্যে ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্লিনিক্যাল এসটাবলিশমেন্ট (রেজিস্ট্রেশন, রেগুলেশন অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি) বিল ২০১৭ পাশ করে পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভা।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে দুই হাজার ৮৮টি বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোম রয়েছে। এর মধ্যে কলকাতাতেই রয়েছে ৩৭০টি।
ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের ২০১৫ সালের একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ শ রোগী চিকিৎসার জন্য ভারতে আসেন, যাদের ৯০ শতাংশই কলকাতার করপোরেট হাসপাতালগুলোতে যান।