‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ গ্রন্থটি বাজার থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ

জেসমিন পাপড়ি
2019.02.19
ঢাকা
‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ গ্রন্থটি    বাজার থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন। ঢাকা। ৩১ জানুয়ারি।
ছবি: বেনার নিউজ

ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ বইটির সব কপি বাজার থেকে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত। কোনোভাবেই যেন ওই বই বাজারে বা বই মেলায় না যায়, সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

বইটি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধান কমিটি প্রতিবেদন পাওয়ার পর মঙ্গলবার এ আদেশ দেন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। এর পাশাপাশি বইটির সম্পাদককেও আদালতে তলব করা হয়েছে।

পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান, পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর মোনায়েম খানের ছবি ছাপা হলেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি না ছাপায় ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ বইটিতে ইতিহাস বিকৃতি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধান কমিটি।

বিষয়টির ব্যাখ্যা দিতে আগামী ১২ মার্চ ওই বইটির সম্পাদককে আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছে।

পাকিস্তানের এই দুই শাসক ইতিহাসের অংশ হলেও বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে তাঁদের ছবি ছাপার বিষয়টি যুক্তযুক্ত নয় বলে মনে করেন অনেকেই।

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছিল ‘স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান’। তাদের ঢাকা অফিস ছিল। সেখানে নীতি নির্ধারণী কাজ খুব একটা হতো না। সেটাকে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রূপান্তর করা হয়। সে জন্য আইয়ুব খান, মোনায়েম খানের ছবি ছাপানোর দরকার নেই।”

“এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রূপান্তর করা হয় তখন বঙ্গবন্ধুই ক্ষমতায় ছিলেন। তার হাত দিয়োই প্রথম গভর্ণর নিয়োগ হয়। কাজেই তার বিষয়টি থাকা উচিত ছিল,” বলেন মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
তাঁর মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস বাংলাদেশ ব্যাংক হওয়ার পর থেকেই হওয়া উচিত।“

২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ বইটিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি না ছাপানো ‘ইতিহাস বিকৃতি’ উল্লেখ করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে গত বছরের অক্টোবরে হাইকোর্ট রিট করেন এফবিসিসিআই পরিচালক কাজী এরতেজা হাসান।

তারই পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২ অক্টোবর রুলসহ আদেশ দেয় উচ্চ আদালত। বইটিতে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ অনুসন্ধান কমিটি গঠন করতে অর্থ বিভাগের সচিবকে নির্দেশ দিয়ে এর অগ্রগতি জানিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দিতেও বলা হয়। সেই আদেশ অনুসারেই আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে গঠিত তদন্ত কমিটি। রাষ্ট্রপক্ষের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আল আমিন সরকার ওই প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেন।
রিটকারীর পক্ষে আদালতে শুনানি করেন আইনজীবী এ বি এম আলতাফ হোসেন। তিনি বেনারকে বলেন, “আদালত বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস গ্রন্থের সম্পাদক শুভংকর সাহাকে তলব করেছেন। ১২ মার্চ তাঁকে হাজির হতে বলা হয়েছে। বইটিতে বঙ্গবন্ধুর ছবি কেন পাওয়া যায়নি তিনি সে জবাব দেবেন।”

“বঙ্গবন্ধুর ছবির পরিবর্তে কেন মোনায়েম খান, আইয়ুব খানের ছবি বইটিতে লাগানো হয়েছে সে ব্যাখ্যা তাঁকে দিতে হবে,” বলছিলেন আলতাফ হোসেন।

তিনি বলেন, “এই বইটির যত পুরোনো কপি আছে, আদালত সেগুলো সরিয়ে ফেলতে বলেছেন। ইতিহাস বিকৃতি অমার্জনীয় অপরাধ জানিয়ে আদালত বলেছে এই বইটি যেন বাজারে না ছাড়া হয় বা মেলায় যেন না আসে।”
বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট বঙ্গবন্ধুর ছবি খুঁজে পাওয়া যায়নি এ যুক্তিতে বঙ্গবন্ধুর ছবি বইয়ে অন্তর্ভুক্ত না করার বিষয়টি অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত।
জানা যায়, ড. আতিউর রহমান যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন, তখন ২০১৩ সালে এ বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি ও প্রকাশনার সিদ্ধান্ত হয়। সে সময় বইটি প্রকাশনা উপলক্ষে উপদেষ্টা কমিটি ও সম্পাদনা কমিটি নামে দুটি কমিটি করা হয়।

বইটির সর্বশেষ সম্পাদক ছিলেন ব্যাংকের তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভংকর সাহা। এর আগে এ দায়িত্ব পালন করেন আরেক নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মাহাফুজুর রহমান। এই দুজনই এখন অবসরে।
‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ বইটি নিয়ে সমালোচনা শুরুর পর ব্যাংকের পক্ষ থেকে দেওয়া এক ব্যাখ্যায় বলা হয়, “গ্রন্থটি প্রকাশনার পরপরই এতে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যত্যয় পরিদৃষ্ট হলে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর গ্রন্থটির বিতরণ বন্ধের নির্দেশ দেন এবং গ্রন্থটি রিভিউয়ের জন্য একজন ডেপুটি গভর্নরের নেতৃত্বে একটি রিভিউ কমিটি গঠন করেন।”
এদিকে অনুসন্ধান কমিটি বলেছে, “বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট বঙ্গবন্ধুর ছবি খুঁজে পাওয়া যায়নি—এ যুক্তিতে বঙ্গবন্ধুর ছবি বইয়ে অন্তর্ভুক্ত না করার বিষয়টি অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত।”
বইটি প্রকাশের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছয় কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করে এটি প্রকাশের জন্য গঠিত গবেষণা কমিটি ও সম্পাদনা কমিটির কাজের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।