পশ্চিমবঙ্গে নাগরিকপঞ্জি নিয়ে মুখোমুখি বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস
2018.09.14
কলকাতা
আসামের মতো পশ্চিমবঙ্গেও ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস (এনআরসি) তথা নাগরিকপঞ্জি চালু করার দাবিতে হিন্দুবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) মাঠে নেমেছে। রাজ্যের বিজেপি নেতারা এতদিন এনআরসির দাবিতে কলকাতায় বক্তৃতা–বিবৃতি দিলেও এবার জনমত সংগঠিত করতে প্রচার অভিযানে নামছে।
বিজেপির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বেনারকে বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে এনআরসির প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে আমরা মানুষের কাছে যাচ্ছি। এজন্য রাজ্যের ৩৭টি সাংগঠনিক জেলায় ২০ হাজার কর্মী বাড়ি বাড়ি যাবেন।”
“১৫ সেপ্টেম্বর শনিবার থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত গ্রাম স্তরে ছোট ছোট গ্রুপ মিটিং ও মিছিল, জেলায় সেমিনার করার পাশাপাশি রাজ্যে এনআরসি চালুর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে প্রচারপত্র বিলি করা হবে,” জানান তিনি।
বিজেপির উদ্বাস্তু সেল রাজ্যের নানা প্রান্তে, বিশেষ করে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে ২১ দিন এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের কাজ করবে বলে বিজেপি সূত্রে বলা হয়।
সায়ন্তন বসু দাবি করেন, “রাজ্যে প্রায় এক কোটি অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী রয়েছে। এদের বিতাড়নের কথা আমরা অনেকদিন ধরেই বলে আসছি।”
গত ৩০ জুলাই প্রকাশিত আসামে এনআরসির চূড়ান্ত খসড়ায় প্রায় ৪০ লাখ মানুষের নাম বাদ পড়ায় প্রবল বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সেই বিতর্কের রেশ এসে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গেও।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এনআরসির বিরোধীতায় সবচেয়ে বেশি সরব হয়েছেন। তিনি মনে করেন, বাঙালি বিদ্বেষ থেকেই আসামে তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এসব হতে দেবেন না বলেও তিনি সম্প্রতি সাংবাদিকদের জানান।
তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব ও মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় শুক্রবার বেনারকে বলেন, “নাগরিকপঞ্জী নিয়ে বিজেপি যা করছে তা পাগলামি ছাড়া আর কিছুই নয়। ভারতীয় নাগরিকরা তো ভারতেই থাকবে। আমরা মানুষকে সঙ্গে নিয়েই এসবের মোকাবিলা করব।”
তিনি আরও বলেন, “ওদের কাজই হচ্ছে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিভেদ তৈরি করা । পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে এসব হতে দেওয়া হবে না।”
বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক রাহুল সিনহা মনে করেন, “বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ পশ্চিমবঙ্গে একটি বড় সমস্যা।” সম্প্রতি গণমাধ্যমে তিনি বলেন, “মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের জন্য রাজ্যের উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ব্যহত হচ্ছে। সেটাই আমরা মানুষকে বোঝাব।”
তিনি অভিযোগ করেন, “নির্বাচনে জিততেই মমতা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারিদের সমর্থন করছেন।”
বিজেপি নেতারা অবশ্য যুক্তি দিয়েছেন, হিন্দুদের মধ্যে যারা নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশ থেকে চলে এসেছে তাঁদের শরণার্থীর মর্যাদা দেওয়া হবে। এজন্য নাগরিকত্ব বিল সংশোধন করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিলটি লোকসভায় পাশ হয়েছে। এখন রাজ্য সভায় পাশ হওয়া বাকি।
কলকাতার গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত খবরে বলা হচ্ছে, বিজেপির শীর্ষ নেতারা আগামী নির্বাচনে বিদেশি অনুপ্রবেশকেই যে ইস্যু করতে যাচ্ছে, সেকথা শীর্ষ নেতারা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিজেপির জাতীয় কর্ম সমিতিতে স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ গত মঙ্গলবার জয়পুরে এক প্রকাশ্য সভায় বলেছেন, “অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারিদের চিহ্নিত করে একে একে সবাইকে ফেরত পাঠানো হবে।”
ব্যর্থতা আড়াল করতেই এই কর্মসূচি
“দেশের মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলির সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েই মানুষের দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য এনআরসি ইস্যু নিয়ে বিজেপি লাফালাফি শুরু করেছে,” শুক্রবার বেনারকে বলেন মার্কসবাদী কমিউনিষ্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রবীন দেব।
তিনি বলেন, “মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরিই বিজেপির একমাত্র কাজ। আর তাই নির্বাচন সামনে রেখে দলটি তাদের শাখা সংগঠনগুলিকে কাজে লাগিয়ে মেরুকরণের কাজ করতে তৎপর হয়ে উঠেছে।”
প্রগতিশীল মুসলিম সমাজ–এর সাধারণ সম্পাদক তোজাম্মেল হক মোল্লা বেনারকে বলেন, “বিজেপির কাছে আগামী নির্বাচন খুবই কঠিন। আর তাই এনআরসি নিয়ে নেতারা সোচ্চার হয়ে উঠেছেন।”
পশ্চিমবঙ্গকে টার্গেট করার কারণ ব্যখ্যা করে তিনি বলেন, “বিজেপি আশা করছে, অন্য রাজ্যে নির্বাচনে ক্ষতি হলে সেটা পশ্চিমবঙ্গে তারা পুষিয়ে নেবেন। রাজ্যের সাম্প্রতিক স্থানীয় নির্বাচনে ভালো ফলের পর বিজেপি আশান্বিত হয়ে মেরুকরণের লক্ষ্যে এনআরসি নিয়ে ব্যাপক প্রচারে নেমেছে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী মনে করেন, “নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে রাজ্যে এনআরসির দাবিতে বিজেপির এই প্রচারাভিযান বুমেরাং হবে। নির্বাচনে বিজেপির কোনও ফায়দা তো হবেই না। বরং রাজ্যে বিরোধী পরিসর আরও সংকুচিত হবে।”
তিনি বেনারকে বলেন, “বিজেপির প্রচারের ফলে মুসলিম ভোট আরও সংহত হবে। অন্যদিকে হিন্দুদের মধ্যে আতংকের পরিস্থিতি তৈরি হবে। রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল এসবের রাজনৈতিক ফায়দা তুলবে।”