আবাসন সংকটে শহরের লাখো কর্মজীবী নারী
2020.10.01
ঢাকা
কর্মক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি তাঁদের আবাসন সুযোগ, ফলে পদে পদে হয়রানি ও নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে দেশের শহরকেন্দ্রিক প্রায় অর্ধকোটি কর্মজীবী নারীর।
দেশের মোট আটটি সরকারি কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে আবাসন সুবিধা আছে মাত্র দুই হাজার ১৪৪ জনের। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় রয়েছেন অবিবাহিত, বিধবা অথবা বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে একা জীবনযাপন করা কর্মজীবী নারীরা।
“পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একাকী জীবন-যাপনকারী নারীদের কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় না। নারীদের জন্য যেসব হোস্টেল রয়েছে সেগুলোও কঠিন অনুশাসনের নিগড়ে বাঁধা,” বেনারকে বলেন ঢাকা আহছানিয়া মিশনের কেএনএইচ পরিত্যক্ত নারী ও দুস্থ শিশু কেন্দ্রের ম্যানেজার শিরিন সুলতানা।
তবে কর্মজীবী নারীদের আবাসন সমস্যা সমাধানে বিদ্যমান সরকারি হোস্টেলগুলো সম্প্রসারণের পাশাপাশি ঢাকায় আরও আবাসন কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে বলে বেনারকে জানান মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা ইন্দিরা।
“দেশের সকল জেলায় বহুতল বিশিষ্ট নারী কেন্দ্র গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ভবন হবে ১০ তলা বিশিষ্ট। প্রথম পর্যায়ে ১৩ টি জেলায় প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এসব ভবনে কর্মজীবী নারীদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে,” বলেন তিনি।
তবে এই সামান্য উদ্যোগ দিয়ে সরকার “কয়জন নারীকে আবাসন সুবিধা দিতে পারবে?” প্রশ্ন তুলে বেসরকারি সংস্থা ‘কর্মজীবী নারী’র নির্বাহী পরিচালক ও সংসদ সদস্য শিরীন আখতার বেনারকে বলেন, “কর্মজীবী নারীর আবাসন সুবিধা সম্প্রসারণের জন্য আরো বড় উদ্যোগ নেওয়া দরকার।”
কর্মজীবী নারী, বিশেষত যেসব নারী একা জীবন-যাপন করেন তাঁদের আবাসনের সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে যুক্ত জানিয়ে তিনি বলেন, “সমাজে একজন নারী প্রয়োজনে একা বাস করবেন এবং নারী একাই নিরাপদ; এই নিশ্চয়তা রাষ্ট্রকেই দিতে হবে।”
“পুরুষের মতো নারীরও নির্বিঘ্নে একাকী বাস করার নিঃশঙ্ক পরিবেশ তৈরি হলে তাঁদের আবাসন সমস্যা আজ প্রকট হতো না,” যোগ করেন এই নারী নেত্রী।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জনশক্তি জরিপ (২০১৬-১৭) অনুযায়ী দেশে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ৪৫.৭ লাখ, যাদের বেশিরভাগই বাস করেন শহরাঞ্চলে।
একা থাকার তিক্ত অভিজ্ঞতা
অবিবাহিত শিরিন সুলতানার স্থায়ী নিবাস বরিশাল। ১৯৯৯ সালে প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রে কর্মজীবন শুরুর পর থেকে গত ২০ বছরে রাজধানীর বিভিন্ন নারী হোস্টেলে বসবাস করে আসছেন তিনি। সর্বশেষ ছিলেন ঢাকার মিরপুর-১০এ বেসরকারি ‘মানবী’ মহিলা হোস্টেলে।
তিনি বলেন, “করোনা মহামারির কারণে গত ২৩ মার্চ এক ঘণ্টার নোটিশে আমাদের সবাইকে হোস্টেল থেকে বের করে দেয়। মুহূর্তে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন ৬০ জন নারী।”
“একা মেয়ে মানুষের বাসা পাওয়া কঠিন; কোনো পরিবারের সঙ্গে সাবলেটে থাকতে গেলে নানা রকমের সমস্যা হয়। তাই এত বছর যাবৎ হোস্টেলে আছি। মানবী হোস্টেল থেকে বের করে দেওয়ার পর থেকে অফিসেই থাকছি,” বলেন শিরিন।
তাঁর বর্তমান অফিসটি মূলত পরিত্যক্ত নারী ও দুস্থ শিশুদের একটি আবাসন কেন্দ্র। এর আগে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ঢাকার অন্তত ১১টি হোস্টেলে থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছে শিরিনের।
“সরকারি হোস্টেলগুলোতে অল্প ব্যয়ে থাকা যায়,” জানিয়ে শিরিন বলেন, “তবে হাতে গোনা দু’একটির পরিবেশ ভালো, যেগুলো ব্যয়বহুল। বাকি প্রায় সবগুলোয় ছোট ছোট রুমে পাঁচ-ছয়জনকে থাকতে হয়।”
এমফিল সম্পন্ন করা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থেকেছেন জানিয়ে দৈনিক ভোরের কাগজের জেষ্ঠ্য প্রতিবেদক ঝর্ণা মনি বেনারকে বলেন, “এরপর ২০১১ সাল থেকে শুরু হয় সমস্যা। কোথাও থাকার জায়গা পাচ্ছিলাম না।”
“আমি একজন নারী, বিয়ে করিনি, জিনসের প্যান্ট পরি, তদুপরি বাসায় ফেরার সুনির্দিষ্ট সময় নেই,” জানিয়ে ঝর্ণা বলেন, “সাংবাদিকতা পেশার কারণে অনেক সময় রাত অবধি বাইরে থাকতে হয়। তাই কেউ বাসা ভাড়া দিতে রাজি হচ্ছিল না।”
এখন তাঁর সঙ্গে থাকার জন্য মা-বাবাকে নিয়ে আসার পরও বাসা পেতে সমস্যা হয় বলে জানান ঝর্ণা।
তিনি বলেন, “এর প্রধান কারণ মাঝে মাঝে বাসায় ফিরতে দেরি করা। আমি সাংবাদিক তাতে কী? একজন মেয়ে মানুষ রাত ১১টা-১২টা পর্যন্ত বাইরে থাকবে তা এখনও অধিকাংশ মানুষ তা মেনে নিতেই পারে না।”
সরকারি হোস্টেলে আসন সংকট
ঢাকার নীলক্ষেতের কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের মোট আসন সংখ্যা ৫২৩টি, এর মাঝে খালি থাকা মাত্র তিনটি আসনের জন্য প্রায় একশ আবেদন জমা পড়েছে বলে বেনারকে জানান হোস্টেলের সুপার সাবেকুন নাহার।
তিনি বলেন, “যেহেতু সিট কম, তাই সিট পেতে অনেকেই বিভিন্ন জায়গা থেকে তদবির করেন।”
মিরপুরের টোলারবাগে নবাব ফয়জুন্নেসা কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের পরিবেশ খুবই নোংরা বলে অভিযোগ সেখানকার সাবেক ও বর্তমান বোর্ডারদের। অথচ প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছামিনা হাফিজ বেনারকে জানিয়েছেন, সেখানেও ১৬০ সিটের প্রতিটির বিপরীতে ২৫-৩০টি আবেদন আসে।
“পরিবেশ খারাপ হলে এত মানুষ সিটের জন্য আবেদন করতেন না,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এখানে উন্নয়নের কাজ চলছে। তিনতলা হোস্টেলটি ভেঙে ১০ তলা পর্যন্ত করা হবে। কাজ শেষ হলে আসনসংখ্যা হবে ৮৫০। সেবার মানও বাড়বে।”
বেসরকারি হোস্টেলে ভাড়া বেশি
ভুক্তভোগীরা বলছেন নারীদের পুরুষ শিক্ষার্থী বা কর্মজীবীদের মতো কয়েকজন মিলে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকার সুযোগ না থাকায় একা বসবাসকারী মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক আবাসনের সন্ধান করা ছাড়া উপায় থাকে না।
অন্য দিকে নারী হোস্টেল সংখ্যায় কম থাকায় বেসরকারি হোস্টেল মালিকেরা বেশি ভাড়া আদায়ের সুযোগ পাচ্ছে।
তবে একাধিক ভবন মালিক বেনারকে জানান, চাহিদা থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ বাড়িওয়ালা নিরাপত্তাজনিত কারণে মেয়েদের হোস্টেল বানাতে সাহসী হন না। এই নিরাপত্তার অজুহাতেই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেন বেসরকারি নারী হোস্টেলের মালিকরা।
সেগুনবাগিচায় ৩০৪ তোপখানা রোডের ভবন মালিক নাসির উদ্দিন তাঁর বাসায় নারীদের জন্য হোস্টেল করেছেন। বেনারকে তিনি বলেন, “মেয়েদের হোস্টেল চালানোর ঝক্কি ঝামেলা অনেক। এ জন্য বাড়তি নিরাপত্তা লাগে, নজরদারি রাখতে হয়। যে কারণে এখানে ভাড়াও কিছুটা বেশি।”
এদিকে মেয়েদের হোস্টেল পরিচালনার জন্য আলাদা কোনো নীতিমালা নেই বলে জানান সংসদ সদস্য শিরীন আখতার।
তিনি বলেন, “১৯৯১ সালের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ও সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী হোস্টেলের বাসিন্দাদের ভাড়া নির্ধারিত হওয়ার কথা। তবে তা মানা হচ্ছে না।”
তাঁর মতে, এই সংকট নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম অন্তরায়। নিরাপদ বাসস্থানের নিশ্চয়তা না পেয়ে কর্মবিমুখও হচ্ছেন অনেক নারী।