জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারী প্রার্থী পাঁচ শতাংশের কম
2023.12.22
ঢাকা

বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও রাজনীতিতে তারা পিছিয়ে পড়েছেন। আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাঁচ শতাংশের কম নারী প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন।
নারী নেত্রীদের মতে, দেশের ইতিহাসে ছয়টি পূর্ণ মেয়াদে দুই জন নারী প্রধানমন্ত্রী সরকার পরিচালনা করায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রশাসনসহ বিভিন্ন খাতে নারীরা এগিয়ে গেছে। তবে সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা এবং ধর্মীয় রীতির কারণে রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ প্রত্যাশিত হারে বাড়েনি।
আসন্ন নির্বাচনে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা অনুসারে, ৩০০ আসনে মোট এক হাজার ৮৯৫ জন প্রার্থীর মধ্যে নারী মাত্র ৯২ জন, শতাংশের হিসাবে দাঁড়ায় চার দশমিক ৮৫ শতাংশ।
এর মধ্যে ৬৭ জন ১৪টি রাজনৈতিক দল থেকে ২৫ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিচ্ছেন।
রাজধানীসহ ঢাকা জেলার ২০টি আসনে নারী প্রার্থী ১১ জন, বন্দরনগরী চট্টগ্রামে মোট ১৬টি আসনে নারী প্রার্থী মাত্র একজন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে সাত দশমিক ৬০ শতাংশ, বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে তিন দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং স্বতন্ত্র ছয় দশমিক ৫২ শতাংশ প্রার্থী নারী।
নারী নেত্রী ও মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির বেনারকে বলেন, “স্বাধীনতার ৫২ বছর পরে নারী প্রার্থীর এই সংখ্যা আমাদের কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এতে বোঝা যাচ্ছে রাজনীতি যারা নিয়ন্ত্রণ করে তাদেরসহ অনেকেরই মানসিকতা এখনো মুক্ত হতে পারেনি। যদিও স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীরা সমান তালে অংশগ্রহণ করেছিলেন।”
নারীদের সক্ষমতা বা যোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই মন্তব্য করেন তিনি বলেন, “প্রশ্ন হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তা-ভাবনা নিয়ে। আরপিওর (গণপ্রতিনিধিত্ব আইন) বিধান রাজনৈতিক দলগুলো মানেনি, নির্বাচন কমিশনও চাপ দেয়নি। নির্বাচন কমিশনেরও সদিচ্ছার অভাব দেখা যাচ্ছে।”
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে পুরুষ আট কোটি ১৭ লাখ ও নারী আট কোটি ৩৪ লাখ। এর মধ্যে মোট ভোটার প্রায় ১১ কোটি ৯৭ লাখ।
পুরুষ ভোটার ছয় কোটি সাত লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ জন, নারী ভোটার পাঁচ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার।
সরকারি হিসেবে, দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বেশ কয়েক বছর আগে লিঙ্গ সমতা ফিরে এসেছে, এখন শিক্ষার এই দুটি স্তরে ছাত্রের চেয়ে ছাত্রী বেশি। গত নভেম্বর মাসে প্রকাশিত এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৭৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ছিল ৮০ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম বেনারকে বলেন, “শিক্ষায় নারীরা এগিয়েছে, কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোতে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব নেই। কাঙ্ক্ষিত হারে তারা মনোনয়নও দেয়নি। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণে যদি নারী না আসে, তাহলে বৈষম্য দূর হচ্ছে না, হবেও না।"
রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে নারীবান্ধব রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এখন আমাদের রাজনীতিতে অর্থের প্রতাপ, অস্ত্রের প্রতাপ ও পেশিশক্তির প্রতাপ। এখান থেকে আমাদের বের হতে হবে।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, “সমাজেই নারীরা কোণঠাসা। সমাজে যে সংস্কৃতি বিরাজ করছে, সেটাই আমরা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে দেখতে পাই। নারীরা সামাজিক সংগঠন করছে, চাকরি করছে, এটা মেনে নিতে পারলেও নারীরা রাজনীতি করছে এটা মানার মতো মানসিকতা এখনো আমাদের অধিকাংশ মানুষের তৈরি হয়নি। ”
“নানা কারণে দলের মধ্যে নারীরা পুরুষের সঙ্গে পেরে ওঠে না। সংসারের চাপ নারীর ওপর থাকে, দলের ভেতর থেকেই নারীরাই ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হয়। রাজনীতি করতে যে পেশি ও অর্থের দরকার হয়, সেখানেও নারীরা পিছিয়ে থাকে। আবার যোগ্যতাসম্পন্ন নারীদের ‘মহিলা সংগঠনের’ ভার দিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করে দেওয়া হয়,” বলেন তিনি।
দলের ভেতরে নারীকে নিজেদের শক্তি ভাবতে হবে মন্তব্য করে শান্তনু বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো সদিচ্ছার ব্যাপার যেমন আছে, নারীদেরও এগিয়ে আসার ব্যাপার আছে।”
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বেনারকে বলেন, “নারীর ক্ষমতায়নের একটি বড় শর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। কিন্তু রাজনীতিতে শুধু কর্মী হিসেবে থাকলে হবে না। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পূর্ব শর্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় থাকা। আরপিওর বিধান সব রাজনৈতিক দল মেনে নিয়েছিল, প্রতিটি নির্বাচন এলেই আমরা দেখি প্রতিশ্রুতি পূরণ দূরের কথা—আমাদের প্রত্যাশাও পূরণ হয় না। এটা একটা দুর্দশার জায়গা যে, নারী প্রার্থী ২০ শতাংশও নেই।”
তিনি বলেন, “সংরক্ষিত নারী আসন নিয়ে বরাবরই আমাদের একটা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ছিল, এরা দলের হয়েই কথা বলেন। নারী সমাজের হয়ে কথা বলেন কতটুকু; এটা সংসদের আলোচনা পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়। আমাদের প্রস্তাবনা ছিল সংরক্ষিত মহিলা আসন থাকলেও এরা যেন সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে আসেন—দলের হয়ে না। সেটাও কার্যকর হয়নি।”
এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার। তিনি বেনারকে বলেন, “নির্বাচন রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সঙ্গে সব সময় সম্পর্কীত নয়। একেক সময় একেকভাবে নির্বাচন হয়। নির্বাচনে অনেক যোগ-বিয়োগ করতে হয়। এই নির্বাচনে অনেক নারী অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিল, হয়তো এই যোগ-বিয়োগের জন্য তা পারেনি।”
চলতি বছরের এপ্রিলে প্রকাশিত ‘মাস্টারকার্ড ইনডেক্স অব উইমেন অন্ট্রাপ্রেনারস’ (এমআইডব্লিউই) জরিপ অনুসারে, বাংলাদেশে বর্তমানে উদ্যোক্তার ৩১ দশমিক ছয় শতাংশই নারী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের জুন মাসের শেষে ব্যাংক খাতে মোট জনবলের ১৬ দশমিক ৩২ শতাংশ নারী।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে উচ্চ শিক্ষা শেষে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছেন ঊরসী মাহফিলা ফাতেহা। তিনি বেনারকে বলেন, “নিজের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি আমি যেন আরও অনেক নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারি, তাই উদ্যোক্তা হয়েছি। আমার প্রত্যাশা একদম গ্রামের নারীদের যাতে অর্থনৈতিক উন্নতি হয়, জীবনের উন্নতি হয়, পারিবারিক উন্নতি হয়।”
তিনি বলেন, “আমার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমার পরিবার রাজনৈতিক ঘরানার। তারপরও সব কিছু মিলিয়ে রাজনীতি করার ইচ্ছা হয়নি।”
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ফাতেহা বলেন, “দেশের যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমরা দেখছি, তাতে করে পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক পরিবেশ পাইনি। এজন্য আমার মনে হয়েছে, রাজনীতি করা ঠিক হবে না। তবে ভালো পরিবেশ পেলে অবশ্যই করব।”
উল্লেখ্য, রাজনৈতিক দলের সব পর্যায়ে নারী নেতৃত্ব ৩৩ শতাংশ করার বাধ্য-বাধকতার মেয়াদ শেষ হয় ২০২০ সালে। তখন পর্যন্ত দেশের নিবন্ধিত কোনও রাজনৈতিক দলই শর্ত পূরণ করতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনও সময় আরও ১০ বছর বাড়িয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২’র সংশ্লিষ্ট ধারায় সংশোধনী এনেছে, সেই লক্ষ্য এখন ২০৩০ সাল। যদিও নির্বাচন কমিশন বলেছে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করার শর্ত থাকলেও এটি বাধ্যবাধকতা নয়, ঐচ্ছিক বিষয়। এটা বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন উল্লেখ করে ইসি বলেছে, তারা এটা কারও ওপর চাপিয়ে দিতে চায় না।
২০২০ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলের সব পর্যায়ে কমিটিতে নারী নেতৃত্ব ৩৩ শতাংশ করার করাসহ বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি নিয়ে ২০০৮ সালে ইসির নিবন্ধন পায় রাজনৈতিক দলগুলো।