বাংলাদেশের পরিবহন শ্রমিক: নিয়োগপত্র ছাড়াই খাটেন দৈনিক ১৮ ঘণ্টার বেশি

শরীফ খিয়াম
2018.05.01
ঢাকা
নিজের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখাচ্ছেন ১৭–১৮ বছর ধরে দূরপাল্লার বাসের চালক বাগেরহাটের মো. জাকির হোসেন। নিজের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখাচ্ছেন ১৭–১৮ বছর ধরে দূরপাল্লার বাসের চালক বাগেরহাটের মো. জাকির হোসেন। ২৯ এপ্রিল ২০১৮।
শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ

নিয়োগপত্র ছাড়াই বাংলাদেশে পরিবহন শ্রমিকদের কাজ করতে হয় বলে দৈনিক ১৮ ঘণ্টার বেশি পরিশ্রম করেও তাঁরা যেমন কোনো বাড়তি ভাতা পান না, তেমনি চাকরিরও কোনো নিশ্চয়তা নেই তাঁদের।

এদিকে নিয়োগপত্রের অভাবে দেশের প্রায় ৭০ লক্ষ পরিবহন শ্রমিকের কাজ ‘চাকরি’ হিসেবে গণ্য না হওয়ায় তাঁদের জন্য সরকারেরও ‘তেমন কিছু করার নেই’ বলে জানিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র।

পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বেনারকে বলেন, “নিয়োগপত্র না থাকার কারণে এখানে ‘চাকরির’ নিশ্চয়তা নেই। ৭০ লক্ষ শ্রমিক সরকারি কল্যাণ তহবিলের টাকাও তুলতে পারছেন না।”

বাস-মিনিবাস, ট্রাক, লরি, ক্যাভার্ড ভ্যান, সিএনজি অটোরিক্সা বা লেগুনার শ্রমিকরা বর্তমানে দুর্ঘটনায় বা অসুস্থতায় শুধু ইউনিয়নগুলোর নিজস্ব কল্যাণ তহবিল থেকে আর্থিক সাহায্য পান জানিয়ে তিনি বলেন, “কখনো কোনো সরকার পরিবহন শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলেনি।”

ফেডারেশন নেতারা জানান, ২০১৩ সালে গঠিত সরকারি শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে দুর্ঘটনাসহ নানা সমস্যায় ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকদের আর্থিক সাহায্য, বার্ষিক চিকিৎসাভাতার মতো বহু সুবিধা পাওয়ার কথা।

চালকদের পাঁচ বছর মেয়াদী লাইসেন্স নবায়নের সময় বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এই তহবিলের জন্য ২০ শতাংশ হারে ২২০ টাকা কেটে রাখে। আর মালিকদের প্রতি বছর আড়াই শতাংশ হারে অর্থাৎ গাড়িরে রেজিস্ট্রেশন ফি এক লক্ষ টাকা হলে আড়াই হাজার টাকা দিতে হয়।

কর্মঘণ্টা বাড়লেও মিলে না বাড়তি মজুরি

নগর ও দূরপাল্লার পরিবহন শ্রমিকেরা বেনারকে জানান, মালিকদের কৃপণ মনোভাব, সড়ক-মহাসড়কের দুরবস্থা এবং রাস্তা ও ফেরিঘাটের যানজট পরিস্থিতির কারণে অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হয় তাঁদের।

ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা ৩২ বছর বয়সী মো. বশির আট বছর ধরে নগর পরিবহনের মিনিবাস চালাচ্ছেন। তিনি বেনারকে বলেন, “দৈনিক গড়ে ১৮ ঘণ্টা গাড়ি চালাতেই হয়। কখনো কখনো ২৪–২৫ ঘণ্টাও থাকতে হয়।”

বাগেরহাটের চিতলমারীর ৪৫ বছর বয়সী মো. জাকির হোসেন ১৭–১৮ বছর ধরে দূরপাল্লার বাসের চালক। তিনি বেনারকে বলেন, “যাওয়া-আসা এক ‘ট্রিপ’, এভাবে পারিশ্রমিক হিসাব করা হয়। ফেরিঘাটের যানজটের কারণে ঢাকা-গোপালগঞ্জ রুটের ট্রিপ শেষ করতে অনেক সময় ৩৬ থেকে ৪৮ ঘণ্টাও লেগে যায়।”

এই চালক প্রতি ট্রিপে মাত্র ৯০০ টাকা পান। তার সহকারী (হেলপার) পান ৫০০ টাকা এবং সুপারভাইজার ৪০০ টাকা।

আরও একাধিক চালক জানান, খুব বেশি বিশ্রাম না নিলেও নগর পরিবহনের কোনো রুটের বাস-মিনিবাস চালকের পক্ষে দৈনিক দেড় হাজার টাকার বেশি আয় করা সম্ভব না। তাঁদের গড় আয় দৈনিক এক হাজার ২০০ টাকা। আর সহকারীদের ৬০০ থেকে সর্বোচ্চ ৮০০।

চালক-সহকারীদের দেয়া তথ্যানুযায়ী, দূরপাল্লার পরিবহন শ্রমিকরা অনেক সময় ৩০ দিনের মধ্যে ১৪ দিনের বেশি ডিউটি পান না। অনেক বাসের চালক ট্রিপ প্রতি আড়াই হাজার টাকা পান। তবে দামি বাসের চালক- সহকারীদের বেশি টাকা দেয় মালিকেরা।

ওসমান বলেন, “বহু দিন চার ঘণ্টার রাস্তা যেতে ১৬ ঘণ্টা লেগে যায়। কিন্তু এটার জন্য মালিক কখনোই শ্রমিককে ‘ওভারটাইম’ দেয় না।”

“আমাদের পরিবহন শ্রমিকেরা কেউ বেতনভুক্ত না। তারা সবাই ‘ট্রিপ’ ভিত্তিক চুক্তিতে কাজ করে। যে কারণে অতিরিক্ত কাজের জন্য বাড়তি টাকা পায় না,” বলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক।

“তারা চাকরি করলে বিষয়টা আমরা (মন্ত্রণালয়) দেখতে পারতাম,” বেনারকে বলেন মুজিবুল হক।

এদিকে নারায়নগঞ্জের সোহেল রানা প্রায় ১৫ বছর ধরে ঢাকায় সিএনজি অটোরিক্সা চালাচ্ছেন। তিনি জানান, সিএনজি চালকরা সাধারণত সকাল ছয়টা থেকে রাত ১২টা অবধি কাজ করেন। তাঁদের আয়ও এখন ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার বেশি হয় না।

উবার, পাঠাওয়ের মতো বিভিন্ন রাইড শেয়ারিং এ্যাপসের কারণে আয় কমে গেছে বলেও জানান আরো একাধিক সিএনজি চালক।

মহানগরীর লেগুনা সার্ভিসের অধিকাংশ অধিকাংশ চালক ও সহকারী আবার শিশু শ্রমিক। দ্বীপজেলা ভোলা থেকে ঢাকায় আসা পনেরো বছরের কিশোর বাবু গাবতলী থেকে মিরপুর-১২ রুটের লেগুনা চালক।

বেনারকে বলেন, “সকাল ছয়টায় ছাড়ি রাত বারোটায় বন্ধ করি।”

বাবুরও গড় আয় দৈনিক এক হাজার ২০০ থেকে সর্বোচ্চ দেড় হাজার। আর তাঁর দশ বছর বয়সী সহকারীর ৪০০-৫০০ টাকা।

একই রুটের আরেক লেগুনার আট বছর বয়সী সহকারি রাব্বী বেনারকে জানান, সকাল ছয়টা থেকে রাত ১২টা অবধি কাজ করে তা আয় হয় মাত্র দেড়শ টাকা।

 

যে কারণে নিয়োগপত্র পায়নি শ্রমিকেরা

পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের অনাগ্রহের কারণেই মালিকপক্ষের কাছ থেকে শ্রমিকদের নিয়োগপত্র আদায় করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে অনেকেরই।

ফেডারেশন নেতারা “শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলেন না” বলে অভিযোগ করেন সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ইনসুর আলী। তিনি বেনারকে বলেন, “শ্রমিক ফেডারেশনের বর্তমান নেতৃত্ব দীর্ঘ দিন ধরে দায়িত্বে থাকলেও আজ অবধি মালিকদের কাছ থেকে শ্রমিকদের জন্য নিয়োগপত্র আদায় করতে পারেনি।”

“আমরাও বলেছি, শ্রমিকদের নিয়োগপত্র দেওয়া উচিত। কিন্তু মালিক শ্রমিক কোনো পক্ষই খুব বেশি আগ্রহী না। খোদ শ্রমিকরাও খুব বেশি জোরদার দাবি তুলছে না,” বেনারকে বলেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী।

তবে ফেডারেশন মালিকপক্ষের কাছে নিয়োগপত্র চেয়েছে বলে বেনারকে জানান সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী। তিনি বলেন, “আমরা ৩৫ বছর ধরে দাবি জানিয়ে আসছি।”

“নিয়োপত্র দেয়ার ব্যাপারে ১৯৮০ সালে চুক্তি হয়েছে, ৮২ সালে সরকারি বিধি হয়েছে। কিন্তু সেটা কার্যকর হচ্ছে না। এখানে সরকারেরও অসহযোগিতা আছে,” বলেন এই নেতা।

এদিকে “শ্রমিকদের নিয়োগপত্র দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে তাঁরাও ভাবছেন,” বলে বেনারকে জানান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ।

“সরকার ও শ্রমিকদের সাথে এ ব্যাপারে সমঝোতা হয়েছে,” যোগ করেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।