এটিএম বুথে অর্থ জালিয়াতি‏, ১ বিদেশি সহ ৪ গ্রেপ্তার

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.02.22
BD-atm এটিএম বুথে জালিয়াতির ঘটনায় এক বিদেশি নাগরিকসহ চার জনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
বেনার নিউজ

স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্যাদি চুরির পর নকল কার্ড তৈরি করে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা তুলে নিয়েছে একটি চক্র। এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনা বাংলাদেশে এটাই প্রথম। এর প্রায় দু’সপ্তাহ পর এক বিদেশি নাগরিকসহ চার জনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এরা আন্তর্জাতিক জালিয়াতি চক্রের সদস্য বলে দাবি পুলিশের।

এদিকে ওই ঘটনার পর সারা দেশের প্রায় ৯০ লাখ এটিএম কার্ড গ্রাহক নিজেদের সঞ্চয় নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তবে ব্যাংক সেক্টরের কড়া নিরাপত্তা সুরক্ষায় এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।


আটক যারা

পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) জানিয়েছে, ব্যাংকের এটিএম বুথে কার্ড জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক বিদেশি নাগরিকের নাম পিওটর সিজোফেন মাজুরেক (ছদ্মনাম থমাস পিটার)। ওই ঘটনায়  আটক হয়েছেন সিটি ব্যাংকের আরও তিন কর্মকর্তা। এরা হলেন মকসেদ আলম ওরফে মাকসুদ, রেজাউল করিম ও রেফাজ আহমেদ। তারা ব্যাংকের কার্ড ডিভিশনে কর্মরত।

পুলিশ জানায়, পিওটরের জন্মস্থান ইউক্রেন। তবে তিনি জার্মানির নাগরিক। আর থমাস পিটার নামে তার পোল্যান্ডের পাসপোর্ট রয়েছে। তিনি গুলশানে থাকেন।

সোমবার ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ ব্রিফিং নবগঠিত কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মনিরুল ইসলাম  রাজধানীর গুলশানে পিওটরের নিজের বাসা ও বিভিন্ন এলাকা থেকে রোববার রাতে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই অভিযানে নেতৃত্ব দেন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. শাহজাহান।  

ডিবি জানিয়েছে, এই চক্রের সঙ্গে অন্য ব্যাংকের আরও কয়েকজন জড়িত। এগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।


‘আন্তর্জাতিক চক্র জড়িত’

পুলিশ বলছে, ব্যাংকের এটিএম বুথে কার্ড জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতরা আন্তর্জাতিক চক্রের সদস্য বলে আটক পিটার প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন। চক্রটি ইউরোপের রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, ইউক্রেন ও পোল্যান্ডভিত্তিক। এরা ইউরোপ, আফ্রিকাসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে তৎপর। পিওটর দীর্ঘদিন ধরে এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। এ কাজে তার সঙ্গে লন্ডনপ্রবাসী এক বাংলাদেশি, বুলগেরিয়ার ও ইউক্রেনের একজন করে নাগরিক জড়িত আছেন। এছাড়া  গ্রেপ্তারকৃত সিটি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তারও যোগসাজশ রয়েছে।

পুলিশের কাছে স্বীকার করা পিওটরের তথ্য উদ্ধৃত করে ব্রিফিংয়ে ডিবি জানায়, এক বছর আগে বিজনেস ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসেন তিনি। তবে কিছুদিন আগে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়। এর আগে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তারা। বিভিন্ন এটিএম বুথ থেকে শত শত কোটি টাকা সরানোর কথাও স্বীকার করে পিওটর। এরপরে বাংলাদেশিদের  টাকায় হাত দেন তিনি। আর এ কাজে সহায়ক হয় সিটি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তার কাছে থাকা পাঞ্চ মেশিন। তবে ঘটনার জন্য পিওটর ‘অনুতপ্ত’ বলে পুলিকে জানান তিনি।


ছয় দিনের রিমান্ডে আটকৃতরা

পিওটর সিজোফেন মাজুরেক,  মোরশেদ আলম মাকসুদ, রেজাউল করিম  রিয়াজ আহমেদকে আটকের পর পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে  ছয় দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ঢাকার মহানগর হাকিম মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম রিমান্ড আবেদনের শুনানি শেষে সোমবার এই আদেশ দেন। এর আগে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির উপপরিদর্শক সোহরাব মিয়া আসামিদের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন।

ওই রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক জালিয়াতি চক্রের এই সদস্যরা আধুনিক কম্পিউটার প্রযুক্তির সাহায্যে বিভিন্ন গ্রাহকের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বের করতে আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি।

চলতি মাসের ৭ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বেসরকারি ইস্টার্ন, সিটি ও ইউসিবিএল ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে অন্তত ২০ লাখ টাকা তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এরপর ঘটনার শিকার গ্রাহকেরা ছাড়াও ইউসিবিএল, সিটি ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের করা  মামলার প্রেক্ষিতে জড়িতদের ধরতে  মাঠে নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।


আরো নিরাপত্তা বাড়ানোর দাবি

এদিকে ওই ঘটনার পর আতঙ্কিত গ্রাহকরা ব্যাংকের নিরাপত্তা আরো জোরদারের দাবি জানিয়েছেন। এ বিষয়ে বেসরকারী একটি ব্যাংকের গ্রাহক আতিকুর রহমান বেনারকে বলেন, ব্যাংক মানে ভরসার জায়গা। আধুনিক যুগে নিজের অর্থ কিংবা সম্পদ আরো সুরক্ষিত রাখতেই আমরা ব্যাংকে যাই। আর কাছে নগদ টাকা রাখার ঝামেলা এড়াতেই এখন এটিএম কার্ডই ভরসা। সেই কার্ড জালিয়াতি করে টাকা তুলে নেওয়ার ঘটনাই প্রচণ্ড আতঙ্কিত বোধ করছি।

সকল ব্যাংকেই টাকা উত্তোলন কিংবা জমা দিলে মোবাইলে যে বার্তাটি আসে সে সুবিধাটি গ্রাহককে আলাদা ফিস দিয়ে নিতে হয়। তবে এখন সময় এসেছে সয়ংক্রিয়ভাবে সুবিধাটি চালু করা এবং তা একদম ফ্রি। যাতে একাউন্ট থেকে টাকা তুলে নেওয়া বা জমা হওয়ার খবরটি সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহক জানতে পারেন।  

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিভিন্ন ব্যাংকের গ্রাহকদের নামে ৯০ লাখের বেশি কার্ড রয়েছে। এদের মধ্যে ডেবিট কার্ডের সংখ্যা ৮৫ লাখ। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায়  ব্যাংকগুলোর সাত হাজার এটিএম বুথের মাধ্যমে এই সেবা নিয়ে থাকে গ্রাহকরা। এছাড়া কেনাকাটার কাজও এর মাধ্যমে করা হয়।


অর্থ ফেরত পাবে গ্রাহক

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় ওই সব জালিয়াতির ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে ‘ব্যাংকের দায় চিহ্নিত করার বিষয়ে’ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এছাড়া যেসব ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের তথ্য জালিয়াতি হয়েছে, তার তালিকা তৈরি করে গ্রাহকদের জানাতে এবং পুরনো কার্ড বাতিল করে নতুন কার্ড দিতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।

ইতিমধ্যে ইস্টার্ন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জালিয়াতি করে এটিএম বুথ থেকে যে সব গ্রাহকের টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে তার পুরোটাই ব্যাংক ফেরত দেবে বলে জানিয়েছে।

ব্যাংকের নিরাপত্তার বিষয়েও কঠোর অবস্থানে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কারণে ব্যাংকগুলোকে এন্টি স্কিমিং ডিভাইস স্থাপন, নিয়মিত ভিডিও ফুটেজ পর্যবেক্ষণ এবং এটিএম বুথে যেন কোনোভাবে বাইরের কেউ কোনো যন্ত্র বসানো বা মেরামতের কাজ করতে না পারে সে বিষয়ে সজাগ থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী  পরিচালক শুভঙ্কর সাহা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।