জেলখানায় নিরাপত্তা জোরদার, জঙ্গি অর্থায়নকারীদের ব্যাংক একাউন্ট স্থগিতের নির্দেশ
2015.10.08

দুই বিদেশি খুন ও আইএসের সম্পৃক্ততার প্রেক্ষাপটে দেশের ৬৫টি কারাগারে আটক ৪৫০ জন জঙ্গিকে ঘিরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। আদালতে শুনানিকালে এইসব জঙ্গিদের সাথে সাক্ষাতকারীরা তদের হাতে বোমা বা বিস্ফোরক তুলে দিতে পারে এবং নভেম্বরের মধ্যে জঙ্গিরা জেলখানাগুলোতে আক্রমন করতে পারে বলে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খবরের কথা জানালেন আইজি প্রিজনস।
এদিকে, জঙ্গি অর্থায়ন বন্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নামে বা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো ধরনের ব্যাংক হিসাব থাকলে তা ৩০ দিনের জন্য স্থগিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা।
বুধবার দেশের কার্যরত ব্যাংকগুলোর নির্বাহীদের কাছে পাঠানো চিঠিতে এ নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
“আপনাদের ব্যাংকে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ নামক জঙ্গি দল বা সংগঠনের নামে বা জঙ্গি সংগঠনের অবৈধ কর্মকাণ্ডে অর্থায়নকারীদের কোনও ধরনের হিসাব পরিচালিত হয়ে থাকলে সে সকল হিসাবের লেনদেন মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর ২৩(১)(গ) ধারার ক্ষমতাবলে আগামী ৩০ দিনের জন্য স্থগিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হলো।”-এমন বার্তাই চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে।
এসব হিসাব স্থগিতের পাশাপাশি তা বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা শাখাকে (বিএফআইইউ) জানানো এবং লেনদেনের তথ্যও পাঠাতে বলা হয়েছে।
এর আগে ২৫ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
এর আগে শাহদাত ই আল হিকমা পার্টি বাংলাদেশ, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ(জেএমবি), জামায়াতুল মুজাহেদীন, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী ও হিজবুত তাহরীর বাংলাদেশকে সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণার পরও ওইসব সংগঠনের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করার নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
৬৫টি কারাগারে নিরাপত্তা জোরদার
কারাগার সমূহের আইজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন বৃহস্পতিবার বেনার নিউজকে বলেন, “বিভিন্ন গণমাধ্যম ও অন্যান্য সূত্রে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে জানতে পেরেছি নভেম্বরে কোনো এক সময়ে জঙ্গিরা কয়েকটি কারাগারে আক্রমন চালাতে পারে। তাই আমরা দেশের ৬৫টি জেলে নিরাপত্তা জোরদার করেছি। গত ২৮ সেপ্টেম্বর ইটালীয় নাগরিক হত্যার পর এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে”।
তিনি জানান, অন্য কারণে আটক কয়েদিদের সাহায্য নিয়ে জঙ্গিরা জেলের ভিতর বোমা সরবরাহ করতে পারে।
ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার আরো জানান,” আদালতে প্রতিটি শুনানির পর জঙ্গিদের জেলে আবারো ঢোকানোর সময় তাদেরকে ভালো করে তল্লাশি করা হচ্ছে। আমরা ছোট-খাটো কয়েদিদের দিকে কম মনোযোগ দিয়ে থাকি, জঙ্গিরা তাদেরকে দিয়েই সেই সুযোগ নিতে পারে”।
ঢাকা কোর্টের আইনজীবী প্রকাশ চন্দ্র বিশ্বাস বেনারকে জানান, হাতকড়া পড়া আসামিরা আদালতে এলে কিছুটা স্বাধীনভাবে থাকতে দেয়া হয়, সে সময় যে কেউ তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারে। কিন্তু তিনি বলেন, পুলিশকে কড়া নজরদারিতে রাখতে হবে যাতে কেউ তাদের হাতে কিছু তুলে দিতে না পারে।
জেল কর্তৃপক্ষ আরো জানান, বন্দিদের আত্নীয়-স্বজন যারা দেখা করতে আসেন তাদের আইডি কার্ড চেক করা হচ্ছে, তাদের ফোন নম্বর নেয়া হচ্ছে এবং তারা যে খাবার নিয়ে আসে সেগুলো খুলে দেখা হচ্ছে।
উল্লেখ্য দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি ও বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীরা সকলেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার ও রাজশাহী কারাগারে আটক রয়েছেন।
‘জঙ্গি অর্থায়নে সহায়তা ব্যাংকের কাজ নয়’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “নিঃসন্দেহে কোন জঙ্গি সংগঠনের অর্থায়নে সহায়তা করা ব্যাংকের কাজ নয়, সেসব কাজে সহায়তা করা উচিতও না। পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন সন্ত্রাস বিরোধী অর্থায়ন নীতিমালা আছে। বাংলাদেশও সেটা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে এদেশের জন্যই মঙ্গলজনক হবে।
জানা যায়, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নিষিদ্ধ সংগঠন বা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠানো হয়।
‘নিজ নামে অর্থ সংগ্রহ করে না জঙ্গি সংগঠন’
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনাকে কেউ কেউ নিতান্তই নামমাত্র বলে অভিযোগ এনেছেন। এ বিষয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক সাব্বির খান বলেন, “হুট করে বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন নির্দেশনা জারি ‘হঠকারী সিদ্ধান্ত’ ছাড়া কিছু নয়। কোন জঙ্গি সংগঠনই নিজের নামে একাউন্ট খোলেনা। বিভিন্ন ব্যক্তির একাউন্টেই মূলত এ ধরনের আদান প্রদানে তারা ব্যবহার করে থাকে। কিছু দিন আগে একজন নারী আইনজীবীর ব্যাংক একাউন্টে জঙ্গি অর্থায়নের প্রমান পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আর এসব ব্যক্তিরা যথাসম্ভব সেটা গোপন রাখার চেষ্টা করে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনা হাস্যকর ও অকার্যকর। বরং অর্থনৈতিক লেনদেনের বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে।”
ব্যাংকগুলোর সতর্ক কার্যক্রম
ব্যাংকগুলো বলছে জঙ্গি অর্থায়নের বিষয়ে বরারবই সচেতন তারা। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা এ ক্ষেত্রে আরো সচেতন করে তুলেছে। বেসরকারী একটি ব্যাংকের বসুন্ধরা শাখার একজন কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, “আগের চেয়ে এখন অর্থ লেনদেনের বিষয়ে ব্যাংক অনেক বেশি সতর্ক।”
মামুনুর রশীদ নামে একই ব্যাংকের একজন গ্রাহক বলেন, “আমি ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে প্রতিমাসে কিছু রেমিটেন্স আয় করি। বৃহস্পতিবারও আমার রেমিটেন্স এসেছে। তবে সে অর্থের উৎস প্রমাণ করতে আগের চেয়ে বেশি কাগজপত্র জমা দিতে হয়েছে আমাকে। ব্যাংক থেকে কয়েক দফায় ফোন করে সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে। এর মাধ্যমে বুঝতে পারছি ব্যাংকগুলো বিদেশি অর্থ আসার বিষয়ে আগের চেয়ে সতর্ক।”
এর আগে জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগে একজন বিএনপি নেতার সন্তানসহ সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবীকে আটক করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র্যাব।
‘শহীদ হামজা ব্রিগেড’ নামে একটি জঙ্গি সংগঠনে অর্থ যোগান দেওয়ার প্রমাণ পাওয়ায় বিএনপি দলীয় সাবেক হুইপ ও কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের মেয়ে ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা ও তার দুই সহযোগী অ্যাডভোকেট মো. হাসানুজ্জামান লিটন ও অ্যাডভোকেট মাহফুজ চৌধুরী বাপনকে আটক করা হয়। তাদের মাধ্যমে শহীদ হামজা ব্রিগেডের বিভিন্ন নেতাদের অ্যাকাউন্টে মোট ১ কোটি ৩৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা জমা হয়েছে বলে অভিযোগ আনে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম জেলায় দায়ের করা একটি মামলা রয়েছে।