পদ্মাসেতুর ব্যয় বেড়ে দাঁড়াল ২৮ হাজার কোটি টাকা
2016.01.05

নিজস্ব অর্থায়নে ২০ হাজার কোটি টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হলেও এ প্রকল্পে নতুন করে আরও ৮ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ অনুমোদন করেছে সরকার। এর ফলে বহুল আলোচিত পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ।
২০০৭ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পটি অনুমোদন করেছিল। পরে নকশা পরিবর্তন হয়ে দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণ ব্যয়ও বেড়ে যায়। ২০১১ সালে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকার সংশোধিত প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পেয়েছিল।
মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে (একনেক) সভায় আরও ৮ হাজার কোটি টাকা অনুমোদন দেওয়া হল।
সরকার বলছে, “এই সেতু নির্মাণ হলে মোট দেশজ আয়ের (জিডিপি) এক দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। বদলে যাবে দক্ষিণাঞ্চলসহ অন্য এলাকার চেহারা।”
সরকারের আশাবাদ হচ্ছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এই সেতু গাড়ি ও ট্রেন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া যাবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে সড়ক পথে রাজধানীসহ মধ্যাঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করতে গত ১২ ডিসেম্বর পদ্মা নদীর ওপর ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু নির্মাণর মূল কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
“পদ্মা সেতু এখন আর কোনো স্বপ্ন নয়, দৃশ্যমান বাস্তবতা। বড় বড় চ্যালেঞ্জ পাড়ি দিতে হয়েছে। এখন শুধু কাজ। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হবে। ২০১৮ সালে ট্রেন ও যানবাহন চলবে,” জানান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
তবে সেতুর ব্যয় ৮ হাজার কোটি টাকা বেড়ে যাওয়া নিয়ে সমালোচনা রয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল একনেক বৈঠকের পর এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “নতুন নতুন অনেকগুলো কম্পোনেন্ট যুক্ত হয়েছে পদ্মা সেতুতে। নদী শাসনের জন্য ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মূল সেতুর খরচও বেড়ে গেছে। তা ছাড়া নতুন করে জমিও অধিগ্রহণ করতে হয়েছে।”
দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ালে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়।
“কারও কাছে ভিক্ষা করে নয়, হাত পেতে নয়, আমরাও পদ্মাসেতুর মতো একটা বিশাল সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করতে পারি। সেই যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতা আমরা অর্জন করেছি,” গত ১২ ডিসেম্বর মূল সেতুর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকায় সেতুর মূল কাঠামো তৈরি করছে। নদী শাসনে সিনোহাইড্রো করপোরেশনকে দিতে হচ্ছে ৮ হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা।
২০১১ সালের প্রথম প্রস্তাবে এ দুই খাতে ব্যয় ধরা হয়েছিল যথাক্রমে ৯ হাজার ১৭২ কোটি ১৭ লাখ এবং ৫ হাজার ৩৬২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।
এ ছাড়া জাজিরা ও মাওয়া সংযোগ সড়ক এবং সার্ভিস এলাকা নির্মাণেও ব্যয় বাড়ছে বলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এ তিন অংশে ব্যয় হচ্ছে যথাক্রমে ১ হাজার ৯৭ কোটি ৩৯ লাখ, ১৯৩ কোটি ৪০ লাখ ও ২০৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এ তিন অংশের কাজই যৌথভাবে করছে বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেড ও মালয়েশিয়ার এইচসিএম কনস্ট্রাকশন।
ইতিমধ্যেই সেতুটির প্রায় ২৭ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে মূল সেতু নির্মাণের ১৭ দশমিক ২৭ শতাংশ, নদী শাসন কাজের ১৩ শতাংশ এবং সংযোগ সড়কের উভয় প্রান্তে প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে। এর আগে পরীক্ষামূলক পাইলিং চললেও এবার শুরু হচ্ছে মূল পাইলিং।
২০১৮ সালে সেতু দিয়ে যুগপৎভাবে যানবাহন ও ট্রেন চলাচল করবে—এই পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে সবকিছু।
সরেজমিনে কর্মযজ্ঞ
সম্প্রতি প্রকল্পের মাওয়া অংশে গিয়ে দেখা যায়, পদ্মার দুই পাড়ে কর্মযজ্ঞ চলছে। মাওয়ায় বড় বড় বার্জে ক্রেন বসানো হয়েছে নির্মাণসামগ্রী ওঠানো-নামানোর জন্য। বড় বড় যন্ত্রে মাটি কাটা ও সমান করা হচ্ছে। চলছে সড়ক নির্মাণ ও সম্প্রসারণের কাজ। পাড়ে গাছ কাটা হচ্ছে। নদীতে চলছে ড্রেজার।
একই রকম কর্মমুখর পরিবেশ শরীয়তপুরের জাজিরা ও শিবচরে। সেখানে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে পাথর-বালু-ইট এনে স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। একটু পর পর ইট-বালু-সিমেন্ট-পাথর-মাটি নিয়ে বড় বড় ট্রাক প্রবেশ করছে নির্মাণ এলাকায়। বড় বড় যন্ত্র দিয়ে মাটি সমান করার কাজ চলছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের সমীক্ষা হয়েছিল জাপানি সংস্থা জাইকার অর্থে। নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে। মূল প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা ও ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দাতারা সরে গেলে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।
সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ চার বছরের মধ্যে শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে ঠিকাদারদের। তবে বড় ধরনের কারিগরি সমস্যা কিংবা রাজনৈতিক বিপর্যয় নেমে না এলে নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ করার আশ্বাস দিয়েছেন ঠিকাদারেরা।
“এই সেতু পুরো জাতির স্বপ্নের প্রকল্প । এটা দ্রুত বাস্তবায়িত হোক, এটা দক্ষিণাঞ্চল বাসীর প্রত্যাশা,” জানান বাগেরহাট শহরের ইট–বালু ব্যবসায়ী হাওলাদার আলী আজম।