চাঁদা না পেয়ে চুলা ছুড়ে চা বিক্রেতাকে হত্যা, ৪ পুলিশ প্রত্যাহার
2016.02.04

ঢাকার ফুটপাতে বসে কেরোসিনের চুলা (স্টোভ) জ্বালিয়ে চা বিক্রি করতেন বাবুল মাতুব্বর (৫০) । গত বুধবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে তাঁর কাছে চাঁদা চেয়ে না পেয়ে বাবুলের ওপর ফিল্মি স্টাইলে তেলের চুলা ছুড়ে মারে পুলিশ। চুলার বিস্ফোরণে বাবুল গুরুতর দগ্ধ হন।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে বাবুল মারা যান। কতিপয় পুলিশের এই নিষ্ঠুর আচরণ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্যে।
জাতীয় সংসদে বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার সমালোচনা হয়েছে, পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তি দৃশ্যমান করার সুপারিশ রেখেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিও।
“বলা হয়, পুলিশ জনগণের বন্ধু। তাহলে এটাই কী জনগণের বন্ধু হওয়ার নিদর্শন?” প্রশ্ন রেখেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান। বেনারকে তিনি বলেন, এটা দুঃখজনক।
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখা বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, চা-দোকানির মৃত্যুর ঘটনায় রাজধানীর শাহ আলী থানার চার পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে । তারা হলেন; পুলিশের এসআই মমিনুর রহমান খান ও নিয়াজউদ্দিন মোল্লা, এএসআই দেবেন্দ্রনাথ এবং কনস্টেবল জসিম উদ্দিন।
সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক পুলিশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি করেছে। গত জানুয়ারিতে দুই এসআইয়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিদর্শক বিকাশ চন্দ্র দাসকে মারধর করার অভিযোগ ওঠে।
এর আগে গত রোববার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে হেনস্তার অভিযোগ ওঠে আদাবর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রতন কুমারের বিরুদ্ধে। এই অভিযোগে করা মামলার বিচার বিভাগীয় তদন্তেরও আদেশ দিয়েছেন আদালত।
বাবুল সপরিবারে মিরপুর ১ নম্বর গুদারাঘাটে থাকতেন। গুদারাঘাটের কিংশুক সমবায় সমিতির পাশে ফুটপাতে চায়ের দোকান দিয়ে চলত তাঁর সংসার।
“ওই দিন একটি মাইক্রোবাসে শাহ আলী থানার একদল পুলিশ চা-দোকানের সামনে গিয়ে আমার শ্বশুরকে বলতে থাকেন, ‘তুই মাদক ব্যবসা করিস, আবার ফুটপাতে বসেছিস, টাকা দিতে হবে।’ এ সময় আমার শ্বশুর বলেন, তিনি মাদক ব্যবসা করেন না। এখন বেচাকেনাও ভালো নয় বলে টাকাও দিতে পারবেন না,” সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন বাবুলের ছেলের স্ত্রী মণি আক্তার।
তিনি বলেন, একপর্যায়ে একজন পুলিশ সদস্য তাঁর শ্বশুরের শরীরের ওপর চুলা ছুড়ে মারেন। এটা বিস্ফোরিত হয়ে তাঁর শরীরে আগুন ধরে যায়। স্থানীয় লোকজন আগুন নিভিয়ে ওনাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নিয়ে যান।
পরিবারের অভিযোগ
মণি আক্তার অভিযোগ করেন, হামলাকারীদের একজন দেলোয়ার হোসেন শাহ আলী থানার পুলিশের কনস্টেবল বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। পুলিশ এই অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছে, থানার ‘সোর্স’ দেলোয়ার এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত।
শাহ আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহীন মণ্ডল সাংবাদিকদের বলেন, দেলোয়ার থানার কনস্টেবল নন, তিনি ‘সোর্স’। ঘটনার সময় থানার কোনো পুলিশ সদস্য সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। সোর্স দেলোয়ারকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি
পুলিশের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে এবং ঘটনাগুলোর কথা উল্লেখ করে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিবৃতি দাবি করেছেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সাংসদ ফজলুর রহমান।
“পুলিশ বাহিনীর ভেতরে এরা কারা? দেশের শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিঘ্নিত করতে কারা এই ধরনের জঘন্য কর্মকাণ্ড করছে?” সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় জানতে চান ফজলুর রহমান। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ৩০০ বিধিতে বিবৃতি দাবি করেন।
শাস্তি দৃশ্যমান করতে হবে
পুলিশের অপরাধগুলোর শাস্তি আরও বেশি দৃশ্যমান করার সুপারিশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি । গত বুধবার ঢাকায় কমিটির বৈঠকে স্থায়ী কমিটি এই পরামর্শ দিয়েছে। বৈঠকে পুলিশের দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে পুলিশ কর্মকর্তাদের কাউন্সেলিং সেবা দেওয়ারও সুপারিশ করা হয়।
বৈঠকে উপস্থিত এমপিদের কয়েকজন মনে করেন, এই ঘটনাগুলোর শাস্তি দৃশ্যমান না হওয়ায় জনগণের কাছে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার পর পুলিশ কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর আর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি, যা নিয়ে মানুষের মধ্যে নানা সমালোচনা ও সন্দেহ রয়েছে।
“পুলিশ বাহিনী শুধু খারাপ নয়, অনেক ভালো কাজও করে থাকে। কিন্তু কিছু সদস্য মাঝেমধ্যে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ ধরনের সদস্যদের শাস্তি নিশ্চিত ও দৃশ্যমান করার সুপারিশ করা হয়েছে,” বেনারকে জানান স্থায়ী কমিটির সদস্য আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন।