সংকট কাটাতে খালেদা সংলাপ চেয়েছেন, সরকারের প্রত্যাখ্যান

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.11.06
BD-politics সম্প্রতি লন্ডনে দলীয় নেতা-কর্মিদের এক সভায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও পুত্র তারেক রহমান বক্তব্য রাখেন।
অনলাইন

দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির  চরম অবনতির মধ্যে  বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপারসন  লন্ডন থেকে সংলাপের আহ্বান জানালেও তা নাকচ করে দিয়েছে সরকার। যদিও সুশীল  সমাজের  অনেকেই  মনে করেন, এখনকার সংকটে একদিকে  রাজনৈতিক  সংলাপ, অন্যদিকে  আইনের শাসন নিশ্চিত  করা জরুরি ।

দেড় মাসের বেশি সময়ে ধরে  লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপি নেত্রী গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে আশা প্রকাশ করেন, “সরকার শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে দেশের এই ক্রান্তিকাল ও সংকটজনক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে গণতন্ত্র বিকাশের ক্ষেত্রকে সংকোচন না করে কর্তৃত্ববাদী মনোভাব থেকে সরে এসে একটি জাতীয় সংলাপের সূচনার পরিবেশকে উন্মুক্ত করবে।”

এর জবাবে  বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদার উদ্দেশে গতকাল শুক্রবার  ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সরকারের  সড়ক  ও জনপথ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “টেমস নদীর পাড় থেকে শব্দ বোমা নিক্ষেপ করে সরকার পরিবর্তন হবে না, জাতীয় ঐক্য হবে না, জাতীয় সংলাপও হবে না।”

“এর আগেও আমরা দেখেছি দুই পক্ষ সংলাপ নিয়ে নাটক করেছে, কিন্তু কেউই সংলাপে বসেনি। আজকের এই পরিস্থিতির জন্য দুই পক্ষই দায়ী, আরও দায়ী যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়ার চেষ্টা,” লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ।

তাঁর মতে, দেশের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হলে আলোচনা, সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধানের দিকে যেতে হবে।

তবে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বলছে, বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়াকে ২০১৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে সংলাপে বসার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তখন যেহেতু বিএনপি সংলাপে বসেনি, সেহেতু এখন আর সেই প্রশ্নই আসে না।

“ওনাকে (খালেদা জিয়া) তো সংলাপে বসতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তখন উনি বসেননি। এখন বসতে চান কেন? প্রশ্ন রাখেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী।

তিনি বলেন, এখন বিএনপি সংলাপে বসার মতো অবস্থায় নেই। ওই দলটি এখন অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে।  


সংলাপ প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া

এই ক্রান্তিকালে সরকার কর্তৃত্ববাদী মনোভাব থেকে সরে এসে জাতির স্বার্থেই একটি জাতীয় সংলাপ শুরুর পরিবেশ উন্মুক্ত করবে-এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

গত বৃহস্পতিবার রাতে এক বিবৃতিতে খালেদা জিয়া এ আশাবাদ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সংকট উত্তরণে সরকারকে সময় থাকতেই উপায় বের করতে হবে। তাঁর দল মনে করে, নির্বাচনকালে নিরপেক্ষ সরকারের অধীন অনতিবিলম্বে একটি নির্বাচনের আয়োজন এখন জরুরি।

লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার এই বিবৃতিটি গণমাধ্যমে পাঠানো হয় বিএনপির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপনের স্বাক্ষরে। বিবৃতিতে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে সরকার নিজেই এই সংকট সৃষ্টি করেছে, যা ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর হয়ে পড়ছে।

দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে কারাগারে পাঠানোর ঘটনা উল্লেখ করে বিএনপির চেয়ারপারসন বিবৃতিতে দাবি করেন, এভাবে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের একের পর এক কারাবন্দী রাখার মধ্যে সরকারের দুরভিসন্ধি রয়েছে।

‘সরকার দেশের সব বিরুদ্ধ মতকে দমনে আজ বেপরোয়া’-এ মন্তব্য করে খালেদা জিয়া বলেন, তারা শুধু বিএনপিই নয়, নাগরিক সমাজ, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার বিরুদ্ধেও সমালোচনা করছে। এমনকি গণমাধ্যমও সরকারি রোষানলের বাইরে নয়।

বিবৃতিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, কতগুলো মৌলিক বিষয়ে সবার মতৈক্য হওয়া আশু প্রয়োজন। তা হলো জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া, সব পর্যায়ে বিচার ব্যবস্থায় স্বাধীন বিবেচনাবোধে কাজ করতে উৎসাহিত করা, গণমাধ্যম এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া, প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া এবং সরকারের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠন করা, রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্যে গ্রেপ্তার করা সব রাজবন্দীর মুক্তি দেওয়া এবং মিথ্যা মামলা তুলে নিয়ে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্র ফিরিয়ে আনা।


ওবায়দুল কাদেরের জবাব

শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে ‘ডিআরইউ সদস্য লেখক সংবর্ধনা-২০১৫’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে দাঁড়িয়ে খালেদা জিয়ার বক্তব্যের জবাব দেন ওবায়েদুল কাদের ।

‘লাগামছাড়া জিহ্বা’ দায়িত্বহীন রাজনীতির মত বিপর্যয় ডেকে আনে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “(বিএনপি নেতারা) শুধু ঢিল ছুড়ছেন, কেউ কাছে থেকে, কেউ দূরে থেকে, কেউ আটলান্টিকের কাছ থেকে কেউ টেমস নদীর তীর থেকে।

“বিদেশের মাটিতে বসে বিক্ষিপ্ত ঢিল ছুড়ে দেশে কি সরকার পরিবর্তন সম্ভব? এ দেশ আফগানিস্তান বা পাকিস্তান নয়; এটা বীরের দেশ, রক্ত দিয়ে এ দেশ অর্জন করেছি।”

সাম্প্রতিক লেখক-প্রকাশক হত্যা এবং পুলিশের ওপর হামলার জন্য খালেদার দল বিএনপিকে দায়ী করে সড়ক পরিবহন মন্ত্রী বলেন, জাতীয় সংলাপ করতে হলে যে পরিবেশ দরকার বিএনপিই তা ‘নষ্ট করছে’।

“এই পরিবেশ কি সংলাপের পরিবেশ? আর সংলাপ করতে পরিবেশের যেমন দরকার, যোগ্যতারও তেমন দরকার,” বলেন কাদের।

তিনি বলেন, যে দল আন্দোলনে জয়ী হতে পারে না, সে দল নির্বাচনেও বিজয়ী হতে পারে না- এটাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস।

“সংলাপে বসার জন্য নিজেদের শক্তি, যোগ্যতা, সাহসের প্রমাণ রাখতে হবে। না হলে শুধু শুধু কার সঙ্গে সংলাপ হবে! সে কি এমন অথরিটি যে তার সাথে বসব? সে যোগ্যতার প্রমাণ তো তারা রাখতে পারেননি।”

বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টার দিকে ইঙ্গিত করে কাদের বলেন, “আজকে দেখতাম বাংলাদেশে ৬৯ এর মতো একটি আন্দোলন বা নিদেন পক্ষে ৯০ এর মতো একটা আন্দোলন হয়েছে- তখন আমরা বুঝতাম সেই শক্তিটা (তাদের) আছে। যোগ্যতা ছাড়া সংলাপ হয় না।”

আন্দোলন করার ‘শক্তি যাদের নেই’ তারা এখন ঘন ঘন সরকার পরিবর্তনের কথা বলছে মন্তব্য করে ক্ষমতাসীন দলের এই নেতা বলেন, “এই মাটিতে যোগ্যতা অর্জন করতে হবে সংলাপের জন্য। সরকার পরিবর্তন নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে হয়, আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হয়।”


সরকার চাপে আছে

একের পর এক রোমহর্ষক ঘটনায় সরকার রীতিমতো অস্থির হয়ে পড়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্কতামূলক নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও একই কায়দায় এসব হত্যাকাণ্ড ও হামলার ঘটনার কথা উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেই বলছেন, ক্ষমতার প্রায় সাত বছরে এর আগে এমন চাপে সরকার আর পড়েনি।

মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে তল্লাশি চৌকিতে একই কায়দায় দুই পুলিশ সদস্যকে হত্যা, তাজিয়া মিছিলে গ্রেনেড হামলায় দুজনের মৃত্যু এবং প্রকাশক ফয়সল হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এর আগে দুই বিদেশি নাগরিককে হত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভাবমূর্তি সংকট তৈরি করে। সবশেষে দুই পুলিশকে হত্যার ঘটনা আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দক্ষতা ও ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

“এই অবস্থার উন্নতি ঘটবে। তবে আর কিছুদিন সময় লাগতে পারে। বিএনপি–জামায়াত জোট বেঁধে যেভাবে আগুন–সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল, সেই অবস্থা থেকে দেশ তো বেরিয়ে এসেছে”, বেনারকে গতকাল রাতে জানান আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ওবায়েদুল কাদের।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।