আদালতের রায়ঃ অপারেশন ক্লিন হার্ট দায়মুক্তি আইন বাতিল ও অসাংবিধানিক‏

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.09.14
BD-rab হাইকোর্ট রোববার র‍্যাবের অপারেশন ক্লিনহার্টের হত্যাকান্ডে দায়মুক্তি আইন বাতিল ও অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছে। ১৩ সেপ্টেম্বর,২০১৫
বেনার নিউজ

একযুগেরও বেশি আগে যৌথ বাহিনী পরিচালিত ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’কে দায়মুক্তি দিয়ে করা আইনকে অসাংবিধানিক ও বাতিল ঘোষণা করেছে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত। একইসঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে চলা ওই অপারেশনে ক্ষতিগ্রস্তদের মামলা করার সুযোগ রয়েছে বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়।

গত রোববার বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।


চার মাসে নিহত অর্ধশতাধিক

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত যৌথ বাহিনীর ওই ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামের অভিযান চালানো  হয়। মাত্র চার মাসের ওই অভিযানে অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যু হয় বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। তবে হৃদেরাগে তাদের মৃত্যু হয়েছিল বলে সে সময় যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।

এরপর ২০০৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন পাস হয়। ওই আইনে বলা হয়, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিধান, সন্ত্রাস দমন এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের মাধ্যমে শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য ২০০২ সালের অক্টোবরে প্রতিরক্ষা বাহিনী, তৎকালীন বিডিআর, পুলিশ, আনসার ও বেসামরিক প্রশাসনের সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী গঠিত হয়। ওই যৌথ বাহিনীর সদস্যদের সব ধরনের কর্মকাণ্ড দায়মুক্ত করার জন্য আইনটি প্রণীত হয়েছিল। এতে ক্ষতিগ্রস্তদের মামলা বা রিটের সুযোগ বন্ধ রাখা হয়।

যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইনের ৩ ধারা অনুসারে, ওই অভিযানকালে শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির দেওয়া আদেশ বা কাজের ফলে কারও প্রাণহানি বা জান-মালের ক্ষতি হলে, কারও অধিকার ক্ষুণ্ন হলে বা কেউ আর্থিক, শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা অন্য কোনোভাবে সংক্ষুব্ধ হলে সে জন্য তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা করা যাবে না বা আইনগত কার্যক্রম চালানো যাবে না।

সেই আইনটি অবৈধ ঘোষনা করে দেওয়া রায়ে বলা হয়েছে, অপারেশন ক্লিন হার্টে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তাঁর পরিবারের সদস্যরা যৌথ বাহিনীর সদস্যের বিরুদ্ধে ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলা করতে পারবেন। এমনকি তাঁরা চাইলে ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদনও করতে পারবেন। তবে তাঁদেরকে পৃথক মামলার মাধ্যমে আসতে হবে।


‘অসাংবিধানিক’

গত রোববার দেওয়া রায়ে যৌথ অভিযান দায়মুক্তির আইনকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে আদালত বলেন, সংবিধানই দেশের সর্বোচ্চ আইন। সংসদ সার্বভৌম কিন্তু সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্য কোনো আইন করতে পারে না। জাতীয় সংসদকে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে সংবিধানের চেতনা পরিপন্থী এ ধরনের আইন প্রণীত না হয়ে যায়। ইচ্ছাকৃত হত্যাকে দায়মুক্তি দিতে সংসদ কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে না। আইনটি জন্মগতভাবে মৃত এবং এর কোনো আইনগত অস্তিত্ব নেই।


১০০ কোটি টাকার আবেদন খারিজ

আইনটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১২ সালের ১৪ জুন হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না। রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে ওই বছরের ২৯ জুলাই রুল জারি করা হয়। রুলে আইনটি কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং যৌথ অভিযানে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে কেন ১০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা ওই রুলে জানতে চাওয়া হয়। আইন, প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্রসচিব, সেনা সদর দপ্তরের কমান্ডার ইন চিফ অব আর্মড ফোর্সেস ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) ছয় সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল।

এরপর রুলের জবাব দেয় সরকার পক্ষ। এর ৩ বছর পর রুল শুনানি শেষে গত রোববার রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। রুল আংশিক মঞ্জুর করে আইনটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করলেও ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠনের আরজি খারিজ করেন আদালত। রায় ঘোষণার সময় রিট আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শাহদীন মালিক, তাঁর সঙ্গে ছিলেন মনজুর আলম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মোতাহার হোসেন সাজু।


‘কেউই আইনের উর্ধ্বে নয়’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু জঘন্যতম অপরাধ উল্লেখ করে রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য থেকে শুরু করে কেউ সংবিধানের ঊর্ধ্বে নন। সংবিধান অনুসারে একজন ভয়ংকর অপরাধীরও আদালতের কাছে বিচার চাওয়ার অধিকার আছে।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় শাহদীন মালিক বেনারকে বলেন, “ওই আইন পাস করিয়ে যৌথ বাহিনীর সদস্যদের আইনের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছিল। তবে হাইকোর্ট এখন যে রায় দিয়েছেন তাতে আরেকবার প্রমাণিত হলো, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদেরকে হাইকোর্টের রিট বেঞ্চে গিয়ে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার অধিকার আদালত দিয়েছেন, যেটা এর আগে কখনো হয়নি।”

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু বেনারকে বলেন, “তৎকালীন সংসদের পাস করা আইনে যৌথ বাহিনীর সেই অপরারেশনের বিরুদ্ধে সেসময় কেউ আদালতের আশ্রয় নিতে পারেননি। থানাগুলোও কোনো জিডি বা মামলা গ্রহণ করেনি। এই রায় ক্ষতিগ্রস্তদের বিচার চাওয়ার পথ আবার খুলে দিয়েছে। এখন ওই সময়ের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ফৌজদারি বা দেওয়ানি আইনে মামলা করতে পারবেন।”

১০০ কোটি টাকার তহবিল বিষয়ে তিনি বলেন, ফৌজদারি দায় ব্যক্তিগত বলে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে যুক্তি দেখানো হয়। এরপর আদালত এ বিষয়ে কোনো প্রতিকার দেয়নি।


‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য সতর্কতা’

এই আইন বাতিল নিয়ে বিএনপি-জামায়াত কোন আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না জানালেও ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’র নামে মানুষ হত্যাকারীদের বিচারের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও বিএনপির উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। তবে একইসঙ্গে তিনি বর্তমান সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও সতর্ক হওয়ার আহবান জানান।

সুপ্রীম কোর্টের এই অ্যাডভোকেট বেনারকে বলেন,  “কোন ধরনের বিচার বহির্ভূত হত্যাকে আমরা সমর্থন দেই না। সেটা যে সরকারের আমলেই হোক না কেন। ওই অপারেশনের নামে মানুষ হত্যার সঙ্গে যারাই জড়িত, যারাই পেশাগত দায়িত্ব পালনের বাইরে অতি উৎসাহি হয়ে মানুষ খুন করেছে তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।”

খন্দকার মাহবুব আরো বলেন,  “বর্তমান সময়েও দেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড চলছে। এসব কর্মকান্ডের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যেসব সদস্য জড়িত এই রায় তাদের জন্যও সতর্ক বার্তা। কারণ, আজ এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হচ্ছেনা বা এই সরকার তাদের বিচারের আওতায় আনছে না বলে পরেও কখনো বিচার হবে না এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। মনে রাখতে হবে ফৌজদারি অপরাধের বিরুদ্ধে যেকোন সময় মামলা করা যেতে পারে। এর জন্য নির্দিষ্ট কোন সময় সীমা নেই।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।