জাতীয় সংসদ বনাম টিআইবি, নতুন বিতর্ক‏

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.10.27
BD-tib গত রবিবার টিআইবি পার্লামেন্ট ওয়াচ বিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশকালে বক্তব্য রাখেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। ২৫ অক্টোবর,২০১৫
বেনার নিউজ

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের কর্মকান্ড এবং ভূমিকা নিয়ে এক নতুন ধরনের বিতর্ক শুরু হয়েছে। যাকে কেন্দ্র করে সরকার এবং দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবি এখন মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের সম্মুখীন। জাতীয় সংসদ পুতুল নাচের নাট্যশালা- ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এমন মন্তব্য থেকেই এ বিতর্কের সূচনা। এর প্রতিবাদ জানিয়ে টিআইবির বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে সরকারি নেতারা।

গত রোববার ঢাকায় প্রকাশিত পার্লামেন্টওয়াচ বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান জাতীয় সংসদ শুধুই নিয়ম রক্ষার এবং এটি কেবল ক্ষমতাসীন দলের একচ্ছত্র ভূবনে পরিণত হয়েছে।


এক বছরে ৭ হাজার বার বিএনপির সমালোচনা

টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, দশম জাতীয় সংসদে প্রতিপক্ষের সমালোচনা আগের চেয়ে ১২ গুণ বেড়েছে। গত এক বছরে ভোট বর্জনের পর আইনসভায় না থাকা বিএনপির সমালোচনা হয়েছে  ৭ হাজার  ২৬৮ বার।

টিআইবির পরিসংখ্যান বলছে, অষ্টম সংসদে বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সমালোচনা হয়েছিল ৪৯১ বার। নবম সংসদে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বিরোধী দল বিএনপির সমালোচনা করেছিল ৮০৪ বার।

সংস্থাটি বলছে, সরকার বিরোধীদের সমালোচনার পাশাপাশি দশম সংসদে নিজ দল ও সরকারের প্রশংসা হয়েছে ৭ হাজার ৫০০ বার। আগের সংসদের দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ অধিবেশনে প্রশংসার ধারা বিশ্লেষণে দেখা যায়, অষ্টম সংসদে সরকারি দলের প্রশংসা হয়েছিল ৬২৬ বার, নবম সংসদে হয়েছিল ৫৯৯ বার।


অকার্যকর বিরোধী দল

প্রতিবেদনে বর্তমান সংসদের বিরোধী দলকে অকার্যকর বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে; যে বিরোধী দল বর্তমান সরকারেরও একটি অংশ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয় দশম সংসদ, যেখানে জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলে রাখা হলেও সরকারেও তাদের প্রতিনিধিত্ব আছে। শুরু থেকেই এই নির্বাচন এবং বিরোধী দল নিয়ে সমালোচনা ছিল। সে নির্বাচনে বিরাট সংখ্যক আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়।


কোরাম সংকটে অর্থ অপচয়

টিআইবির পরিসংখ্যানে আরো বলা হয়, দশম জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ এই পাঁচটি অধিবেশনের ১১২ কার্যদিবসে  ৪৮ ঘণ্টা ৪১ মিনিট কোরাম সঙ্কট ছিল। সংসদ অধিবেশন পরিচালনা করতে প্রতিমিনিটে গড় ব্যয় ১ লাখ ১১ হাজার টাকা। সে হিসেবে কোরাম সঙ্কটে ৩২ কোটি ৪২ লাখ ৩১ হাজার টাকা অপচয় হয়েছে। এ সময়ে সরকার ও বিরোধী দল তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি শক্তিশালী ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছেন স্পীকারও।

তবে এবার সংসদে বিরোধী দলের উপস্থিতি বেড়েছে। নবম সংসদে বিরোধী দলের উপস্থিতির হার চার শতাংশ। থাকলেও এবার তা ৫৩ শতাংশ। তবে এই বিরোধী দল কতটুকু বিরোধী তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে টিআইবি।


নতুন নির্বাচনের তাগিদ

টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “সবকিছু দেখে মনে হয়, বর্তমান সংসদ যেন পুতুল নাচের একটি রঙ্গশালা। সার্বিকভাবে সংসদের কার্যক্রমে আমরা হতাশ। সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য নয়। সংসদীয় আচরণ থেকে ব্যাপক বিচ্যুতি ঘটছে। বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত তথাকথিত বিরোধী দলের কার্যকর কোন ভূমিকা নেই। মূলত ক্ষমতাসীন দলের একচ্ছত্র ভুবন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সংসদ। নিয়ম রক্ষার্থে এ সংসদ চলছে। তাই বিতর্ক এড়াতে নতুন নির্বাচন প্রয়োজন।”

এছাড়া বিধান থাকলেও আন্তর্জাতিক চুক্তি বিষয়ক আলোচনা অনুষ্ঠিত না হওয়া, আইন প্রণয়ন, প্রশ্নোত্তর ও জনগুরুত্বপূর্ণ নোটিশের আলোচনায় সদস্যদের কম অংশগ্রহণ, কমিটির সদস্যদের ব্যবসায়িক সংশ্লিষ্টতাসহ স্বার্থের দ্বন্দ্ব, সংসদীয় কার্যক্রমে তথ্যের উন্মুক্ততা ও অভিগম্যতার ঘাটতি ইত্যাদি কারণে সংসদ প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর হয়নি বলেও টিআইবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।


টিআইবি’র সমালোচনায় চিফ হুইপ

এই গবেষণা প্রতিবেদনের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে টিআইবি’র  বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছেন সংসদের চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ। প্রতিবেদনটি প্রত্যাখ্যান করে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এ ধরনের মন্তব্যের মাধ্যমে টিআইবি দেশের সংবিধান ও জাতীয় সংসদকে অবজ্ঞা করেছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরও অপমানিত করা হয়েছে। এ ধরনের মন্তব্য সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল।

অন্য কয়েকজন হুইপ ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিকে সঙ্গে নিয়ে এই সংবাদ সম্মেলনে চিফ হুইপ বলেন, টিআইবি নিজেরাই নাচের পুতুল ও পেইড এজেন্ট। প্রভুদের সুতার টানেই তারা নাচে।  দেশে দুজন বিদেশি নাগরিক হত্যা ও বোমা হামলায় একজন নিহত হওয়ার সময়কালে টিআইবির এ ধরনের প্রতিবেদন সংসদকে অকার্যকর করার জন্য। কোনো আন্তর্জাতিক মহলের চক্রান্তে তারা এটি করেছে বলে মনে হয়।

সংসদে ক্ষমতাসীন দলের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা’র অভিযোগ প্রসঙ্গে আ স ম ফিরোজ বলেন, “নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সংসদে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পেলে তাতে আওয়ামী লীগের দোষ কোথায়, সে বিষয়টি আমাদের বোধগম্য নয়।”

তবে টিআইবির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে চিফ হুইপ বলেন, “সেটা বলতে পারছি না। কারণ সংসদ নেতা আছেন, স্পিকার আছেন, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা আছেন। তাঁরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন।”


‘সরকারের উচিত টিআইবি’র অভিযোগ খন্ডন করা’

এদিকে টিআইবির প্রতিবেদন বিষয়ে সরকারের এমন প্রতিক্রিয়ার সমালোচনা করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সরকার এ প্রতিবেদন ‘ভুল’ মনে করলে, ‘সঠিক তথ্য’ তুলে ধরতে পারে।

এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “সরকার টিআইবি’র রিপোর্ট নিয়ে কেন এত হইচই করছে, তা আমার বোধগম্য নয়। প্রতিবেদনটি যদি সরকার ঠিক মনে না করে থাকেন, তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ দেওয়া উচিত। সেটা এভাবে সংবাদ সম্মেলনে করে নয়, টিআইবির প্রতিটি অভিযোগের খন্ডন করে, দেশবাসীকে জানানো উচিত। প্রয়োজনে টিআইবিকে লিখিত প্রতিবাদও দেয়া উচিত।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।