লিঙ্গ সমতায় দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে বাংলাদেশ
2015.11.19

নারী-পুরুষের ব্যবধান কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শীর্ষস্থান রেখেছে বাংলাদেশ। টানা নয় বছর ধরে লিঙ্গ বৈষম্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এ উন্নতি মোটামুটি ধারাবাহিকভাবেই চলছে।
বুধবার প্রকাশিত জেনেভাভিত্তিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ‘বিশ্ব লিঙ্গ বৈষম্য প্রতিবেদন ২০১৫’- এ তথ্য প্রকাশ করেছে। অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীর ক্ষমতায়ন-এই চার মাপকাঠির ভিত্তিতে প্রতিবছর এ সূচক প্রকাশ করা হয়।
এ অগ্রগতিকে ‘ইতিবাচক’ বলা হলেও নারী পুরুষের সমতা আনতে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে এখনও অনেক কাজ বাকি আছে সরকারের।
বিশ্বের ১৪৫টি দেশে নারীর পরিস্থিতি নিয়ে করা তৈরি এ সূচকে ৬৪তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। আর গত বছর ১৪২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল ৬৮ নম্বরে। তবে শুধু অবস্থানের উন্নতি নয়, এর পাশাপাশি স্কোরেও অগ্রগতি হয়েছে বাংলাদেশের। গত বছর বাংলাদেশের স্কোর ছিল শূন্য দশমিক ৬৯৭, এবার তা বেড়ে শূন্য দশমিক ৭০৪ হয়েছে।
সবচেয়ে অগ্রগতি স্বাস্থ্যখাতে
প্রতিবেদন মতে, স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে। গত বছর এই মাপকাঠিতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২২তম, এবার একলাফে ২৭ ধাপ এগিয়ে ৯৫তম অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর শূন্য দশমিক ৯৭১।
নারীর প্রাথমিক শিক্ষায় অগ্রগতি, উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে
শুধু তাই-ই নয়, নারীর শিক্ষা ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নেও গত বছরের তুলনায় দুই ধাপ করে এগিয়েছে বাংলাদেশ। গত বছরের মতো এবারও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বিশ্বে প্রথম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণে এবার বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম, স্কোর শূন্য দশমিক ৯৪৮। তবে উচ্চ শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে গতবছরের ১১৮তম অবস্থান থেকে পিছিয়ে এসেছে ১১৯তম অবস্থানে। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে গতবারের দশম থেকে এগিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান এবার অষ্টম; স্কোর শূন্য দশমিক ৪৩৩।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে পিছিয়ে
শিক্ষা বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশের নারীরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ্রহণের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে। এ সূচকে বাংলাদেশ গতবারের চেয়ে দুই ধাপ পিছিয়ে ১৩০তম অবস্থানে এসেছে। আর স্কোর গতবারের শূন্য দশমিক ৪৭৭ থেকে কমে এবার শূন্য দশমিক ৪৬২ হয়েছে।
অন্যান্য সালে বাংলাদেশের অবস্থান
২০০৭ সাল থেকেই লিঙ্গ বৈষম্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে ধারাবাহিক উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ২০০৭ সালে বিশ্বের ১২৮টি দেশের মধ্যে ১০০তম, ২০০৮ সালে ১৩০টি দেশের মধ্যে ৯০তম, ২০০৯ সালে ১৩৪টি দেশের মধ্যে ৯৩তম, ২০১০ সালে ১৩৪টি দেশের মধ্যে ৮২তম, ২০১১ সালে ১৩৫ দেশের মধ্যে ৬৯তম, ২০১২ সালে ১৩৫ দেশের মধ্যে ৮৬তম, ২০১৩ সালে ১৩৬টি দেশের মধ্যে ৭৫তম, ২০১৪ সালে ১৪২ দেশের মধ্যে ৬৮তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ।
সূচকে অ্ন্যান্যদের অবস্থান
২০১৫ সালে প্রকাশিত বিশ্ব লিঙ্গ বৈষম্য প্রতিবেদনে প্রথম অবস্থানে রয়েছে আইসল্যান্ড। টানা সপ্তমবারের মতো এ অবস্থান ধরে রেখেছে দেশটি। এবার আগের বছরের চেয়ে একধাপ এগিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে নরওয়ে। আর একধাপ পিছিয়ে ফিনল্যান্ড আছে তৃতীয় অবস্থানে। এরপর চতুর্থ থেকে দশম অবস্থানে আছে যথাক্রমে সুইডেন, আয়ারল্যান্ড, রুয়ান্ডা, ফিলিপাইনস, সুইজারল্যান্ড, স্লোভেনিয়া ও নিউজিল্যান্ড।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কার অবস্থান বাংলাদেশের ১৬ ধাপ পেছনে, ৮৪ নম্বরে। গত বছরের সূচকে ৭৯তম অবস্থানে ছিল শ্রীলঙ্কা।
ভারত, ভুটান ও নেপাল এবার উন্নতি করেছে। ভারতের অবস্থান ১১৪ থেকে এগিয়ে ১০৮, ভুটান ১২০ থেকে ১১৮ এবং নেপাল ১১২ থেকে দুই ধাপ এগিয়ে ১১০তম অবস্থানে উঠে এসেছে।
অন্যদিকে মালদ্বীপ ১০৫ থেকে পিছিয়ে ১১৩তম এবং পাকিস্তান ১৪১তম অবস্থান থেকে পিছিয়ে ১৪৪ নম্বরে রয়েছে। পাকিস্তানের পরে এ তালিকার একমাত্র দেশ ইয়েমেন, যারা গতবছরও সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে ছিল।
সূচকে অবস্থানের দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশের পাশাপাশি চীন (৯১), জাপান (১০১), কোরিয়া (১১৫), রাশিয়া (৭৫), ব্রাজিল (৮৫), ইন্দোনেশিয়া (৯২) ও মালয়েশিয়ার (১১১) চেয়েও এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
উন্নত দেশগুলোর মধ্যে এবছরের সূচকে ফ্রান্স ১৫, যুক্তরাজ্য ১৮ ও যুক্তরাষ্ট্র ২৮তম অবস্থানে রয়েছে।
‘প্রান্তিক পর্যায় থেকেই নারী পুরুষ বৈষম্য কমাতে হবে’
লিঙ্গ বৈষম্যের ব্যবধান কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এ অগ্রগতি ইতিবাচক বললেও একে ‘দূর থেকে ঘণ বন দেখার অভিজ্ঞতা’র সঙ্গে তুলনা করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন প্রকৃতপক্ষে নারী পুরুষের সমতার জন্য প্রান্তিক অঞ্চল থেকে কাজ শুরু করতে হবে।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-(টিআইবি)'র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বেনারকে বলেন, লিঙ্গ বৈষম্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ধারাবাহিক উন্নতি নিঃসন্দেহে সুখবর। কিন্তু এ পরিস্থিতি খানিকটা দূর থেকে ঘণ বন দেখার মত। কারণ, দূর থেকে বন ঘণ দেখা গেলেও কাছে গেলে অনেক সময় বৃক্ষহীণ দশা বোঝা যায়। সূচকে কিছুটা ভাল অবস্থানে থাকলেও এদেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নারীরা এখনো নির্মম বৈষম্যের শিকার।
নারী পুরুষে সমতা আনতে এই প্রান্তিক পর্যায়ের গভীরে যেতে হবে। সেখানকার গুণগতদিক বিবেচনা করার স্কোপ আছে। সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি নীতি নির্ধারনী পর্যায়েও সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।
এক্ষেত্রে উদাহরণ টেনে তিনি বলেন,বিয়ের ক্ষেত্রে বয়স কমানোর মত সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে কীভাবে নারীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে আরো সাবলম্বী করানো যায় সেদিকে সরকারকে নজর দিতে হবে।
সামান্য এগিয়েছে বিশ্ব
এদিকে গত এক দশকের তথ্য বিশ্লেষণে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের প্রতিবেদন বলছে, কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতার ক্ষেত্রে বিশ্ব সামান্যই এগিয়েছে।
এই সময়ে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারী-পুরুষ ব্যবধান ঘুঁচেছে ৪ শতাংশ, আর্থিক দূরত্ব কমেছে ৩ শতাংশ। অগ্রগতির এই হার অব্যাহত থাকলে নারী-পুরুষের সমতা আসতে ১১৮ বছর লাগবে।