কলকাতায় নির্বাচন থেকে ছিটকে পড়লেন তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থীরা

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2016.05.04
Transgender-Kolkata620.jpg নির্বাচনে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক শঙ্করী মণ্ডল (ডানে), পাশে দলের এক সঙ্গী।
সংগৃহীত

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পথে অনেক দূর এগিয়েছিলেন তৃতীয় লিঙ্গের দুজন মানুষ। শেষ অবধি সমাজের চাপে স্বপ্নপূরণ হল না তাঁদের।

৩১ বছরের শঙ্করী মণ্ডলের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত দিন হতে পারত ৩০ এপ্রিল। সে দিন কলকাতার একাংশ আর দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বিভিন্ন আসনের মধ্যে নির্বাচন হয়েছে যাদবপুর কেন্দ্রেও।

শঙ্করী যাদবপুর কেন্দ্রে ভোটে দাঁড়ানোর কথা ভেবেছিলেন। লোক জনশক্তি পার্টি তাঁকে মনোনয়ন দিতে তৈরি ছিল। কিন্তু, শেষ অবধি আর নির্বাচন কমিশনের কাছে মনোনয়ন পেশ করা হল না তাঁর।

লোক জনশক্তি পার্টির টিকিটেই ভবানীপুর কেন্দ্রে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়ানোর কথা ভেবেছিলেন ববি হালদারও। শেষ অবধি পিছিয়ে এসেছেন তিনিও।

কিন্তু, এ রকম তো কতই হয়। শঙ্করী আর ববির গল্প আলাদা হলো কোথায়? তাঁদের পরিচয়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এই প্রশ্নের উত্তর।

শঙ্করী মণ্ডল ও ববি হালদার—দু’জনেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। কোনো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বিধানসভা নির্বাচনে লড়তে চান, পশ্চিমবঙ্গে এই প্রথম এমন ঘটনা ঘটল।

মনস্থির করেও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গেলেন কেন? ববি হালদার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চাইলেন না। বললেন, ‘লোক জনশক্তি পার্টির রাজ্য সভাপতি মীরা চক্রবর্তীকে জিজ্ঞাসা করুন। তিনি যা বলবেন, সেটাই উত্তর আমার ।’

মীরা চক্রবর্তী বললেন, ‘ববি আর শঙ্করী নির্বাচনে দাঁড়াতে চান, এ কথা জানার পর স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীরা তাঁদের ওপর চাপ তৈরি করেছিলেন। এরপর তাঁরা পিছিয়ে এলেন।’

তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব অবশ্য উড়িয়ে দিলেন এই অভিযোগ। দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী বললেন, ‘মনোনয়ন পেশ করার সময়সীমা উত্তীর্ণ হওয়ার পর প্রায় দেড় মাস কেটে গেছে। কারও সমস্যা হলে তাঁর তো এত দিনে কমিশনের বা পুলিশের কাছে যাওয়া উচিত ছিল। খোঁজ নিয়ে দেখুন, এই নামের কেউ কোনো অভিযোগ করেছেন কি না।’

এ প্রসঙ্গে মীরা চক্রবর্তী বললেন, ‘দু’জন এত ভয় পেয়েছিলেন যে কমিশনের দ্বারস্থ হওয়ার মতো সাহস তাঁদের ছিল না।’

দক্ষিণ কলকাতার শহরতলির এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মেছিলেন শঙ্করী। তাঁর লিঙ্গ পরিচয়ই নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল, বাড়িতে তাঁর থাকা হবে না।

এখন তাঁরই মতো আরও কয়েক জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে থাকেন শঙ্করী। তাঁর আয়ের উৎস কী, সরাসরি সে প্রশ্নের জবাব দেন নি তিনি। বলেন, ‘আপনিই বুঝে নিন না, আমার মতো মানুষ কী ভাবে রোজগার করতে পারে।’

নির্বাচনে দাঁড়ানোর কথা উঠেছিল কী ভাবে? শঙ্করী বললেন, বছরখানেক আগে এক পরিচিতের সূত্রে মীরা চক্রবর্তীর সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। মীরাই প্রস্তাব করেন যে শঙ্করী বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুন। শঙ্করী রাজি হয়ে যান।

এক জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে প্রার্থী করার কথা ভাবলেন কেন তাঁরা? মীরা বললেন, ‘আমাদের দল সব সময়ই সমাজের পিছিয়ে থাকা অংশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায়। শঙ্করী আর ববি ভোটে দাঁড়ালে সমাজের অনেক বেশি মানুষ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সমস্যার বিষয়ে সচেতন হতেন। আমরা জানতাম, তাঁদের জেতার সম্ভাবনা ছিল না। তবুও চেয়েছিলাম, মানুষের কাছে তাঁদের কথা পৌঁছে যাক।’

তিনি ভোটে দাঁড়াতে চান—এটা জানার পর কার, কেমন প্রতিক্রিয়া হল? শঙ্করী বললেন, ‘আমার বাড়ির লোক কেউই খুশি হয়নি। একদম না। আমার দলের লোকদের মধ্যে কয়েক জন খুশি হল। আবার কয়েক জন বলল, খানিকটা অপমানিত হওয়া ছাড়া এতে কোনো লাভ হবে না।’

মীরা চক্রবর্তী বললেন, ‘ববি ও শঙ্করী নির্বাচনে লড়লে একটা সামাজিক বার্তা যেত। তাঁরা মনোনয়ন পেশ করতে না পারায় আমাদের সমাজ পিছিয়েই থাকল।’

এই কথা মানতে অবশ্য প্রস্তুত নন মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিই প্রথম লিঙ্গান্তরিত মানুষ (পুরুষ সোমনাথ থেকে তিনি নারী মানবী হয়েছেন), যিনি পশ্চিমবঙ্গের একটি কলেজের অধ্যক্ষ। মানবী বললেন, ‘সমাজকে পাল্টাতে গেলে নিজের খানিকটা লেখাপড়া থাকতে হয়, সামাজিক সচেতনতা থাকতে হয়। ববি বা শঙ্করীকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি না, কিন্তু তাঁদের এই শিক্ষা বা সচেতনতা ছিল কি?’

সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী গত বছর তাঁর উপন্যাস ‘হলদে গোলাপ’-এর জন্য পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বড় সাহিত্য সম্মান আনন্দ পুরস্কার পেয়েছিলেন। সেই উপন্যাসের কেন্দ্রে ছিল বৃহন্নলা জীবনের কথা।

স্বপ্নময়বাবু বললেন, ‘এই রাজ্যে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অবস্থা সত্যিই খারাপ। বিশেষত যাঁরা নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মান, তাঁদের পদে-পদে হরেক বাধা, হাজার অপমান সহ্য করতে হয়। তাঁদের শিক্ষার ব্যবস্থা নেই, কর্মসংস্থানও হয় না। বহু উন্নত দেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের বিভিন্ন কম দক্ষতার পেশায় চাকরি দেওয়ার রেওয়াজ আছে। তবে আমাদের এখানে সচেতনতা যে বাড়ছে, সেটাও ঠিক।’

আবার যদি সুযোগ আসে, ভোটে দাঁড়াবেন? শঙ্করী প্রথমে ইতস্তত করলেন। তার পর নিচু স্বরে বললেন, ‘বলা যায় না। হয়তো অন্য কোনো দল ডাকলে দাঁড়াব।’

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।