তেলের দর পতনের জের: বাংলাদেশের রেমিটেন্স প্রবাহে ভাটা
2016.02.04

বিশ্ববাজারে অব্যাহতভাবে কমছে জ্বালানি তেলের দাম। আর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। বছরের প্রথম মাসেই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত রেমিটেন্স প্রবাহ কমে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে রেমিটেন্স প্রবাহ অব্যাহত রাখতে অধিক হারে দক্ষ বাংলাদেশি কর্মী পাঠানো এবং বন্ধ শ্রমবাজারগুলো উন্মুক্ত করার প্রতি জোর দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে রেমিটেন্স এসেছে ১১৫ কোটি ২০ লাখ ডলার। যা আর এর আগের মাস ডিসেম্বরের আসে ১৬ কোটি ৬ লাখ ডলার। সেই তুলনায় জানুয়ারিতে ১২ দশমিক ২৪ শতাংশ কম রেমিটেন্স পাওয়া যায়। এই পরিমাণ ২০১৫ সালের জানুয়ারির চেয়ে ৯ কোটি ১৩ লাখ ডলার বা ৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমায় কমেছে ডলারের মূল্য। ফলে রেমিটেন্স কমে আসছে। আবার অনেক প্রবাসীই এই সময়ে টাকা পাঠাতে আগ্রহী হচ্ছেন না। এতে করে কমেছে রেমিটেন্সের পরিমান।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কাজী ছাইদুর রহমান বলেন, রেমিটেন্সের এই নিম্নগতি বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক রকম কমে যাওয়া।
কমেছে তেল উত্তোলনকারী দেশগুলো থেকে আসা রেমিটেন্স
জানা যায়, বাংলাদেশি কর্মীদের প্রধান শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমান রেমিটেন্স আসা কমেছে। এসব দেশগুলোর প্রধান আয় মূলত তেলের ওপর নির্ভরশীল।
এ বিষয়ে ছাইদুর রহমান বলেন, “আমাদের সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসে সৌদি আরব, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ায় তেল উত্তোলনকারী প্রধান এই দেশগুলোর অর্থনীতি কিছুটা সঙ্কটের মুখে পড়েছে। এসব দেশে কর্মরত বাংলাদেশিরা ওভারটাইম করে বাড়তি উপার্জন করতেন। তারা সেটা দেশে পাঠাতেন। এখন আর সেই কাজ পাচ্ছেন না তারা। সঙ্কটে পড়ে ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে ওই দেশগুলো।”
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় জানায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৈধ অবৈধ মিলিয়ে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি বিভিন্ন পেশায় কর্মরত রয়েছেন। যার ৬০ শতাংশের বেশি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজ করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, সৌদি আরব থেকেই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসে। একক দেশ হিসেবে গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মধ্যপ্রাচ্যের তেল প্রধান এ দেশটি থেকে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাওয়া যায়। এছাড়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের আরেকটি প্রধান গন্তব্য মালয়েশিয়ার মুদ্রা রিংগিতের দরপতনের কারণেও দেশটি থেকে রেমিটেন্স কম আসছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্ববাজারে এখন তেলের দাম
গত এক বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্ব বাজারে তেলের দর কমছে। এই সম্প্রতি দর ২২ দশমিক ৪৮ ডলারেও নেমে এসেছিল। তবে তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর জোট ওপেকের তথ্য অনুয়ায়ী, গত ২ ফেব্রুয়ারি প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল ২৯ দশমিক ৬৯ ডলারে বিক্রি হয়েছে। তেলের এই দরপতনে বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা এনেছে। বড় বড় পুঁজিবাজারগুলোতেও দরপতন দেখা দিচ্ছে।
নতুন অর্থবছরে কমে এসেছে রেমিটেন্স
কেন্দ্রীয ব্যাংকের হিসাব বলছে, জানুয়ারিতে রেমিটেন্স কমায় চলতি অর্থবছরের হিসেবে প্রথম সাত মাসের হিসাবেও কমেছে রেমিটেন্স। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি ৮৬৪ কোটি ডলার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। ২০১৪-১৫ একই সময়ে দেশে আসে ৮৭৩ কোটি ডলার। এ হিসেবে এই সাত মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রেমিটেন্স কম এসেছে ১ দশমিক ০৫ শতাংশ।
বিগত অর্থবছরগুলোর রেমিটেন্স
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেমিটেন্স সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা কমে ১৪ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে অবশ্য বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স পাঠান প্রবাসীরা। তবে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ কমলেও রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে।
এদিকে বৈশ্বিক কারণে হলেও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত রেমিটেন্স প্রবাহ কমে আসাকে সতর্ক হিসেবে গ্রহণ করে এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আহবান জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। প্রধান প্রধান শ্রমবাজারগুলো উন্মুক্ত করে আরো অধিক হারে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর পক্ষে মত দিয়েছেন তারা। একই সঙ্গে দক্ষ জনশক্তি তৈরির বিষয়টিকেও গুরুত্বের সঙ্গে দেখার আহবান জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও অভিবাসন বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর সমন্বয়ক ড. সি আর আবরার বেনারকে বলেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রভাবেই রেমিটেন্স কমেছে। ফলে আয় যেমন কমেছে, তেমনি আয় করলেও ডলারের মূল্য কম হওয়ায় অনেকে তা পাঠাচ্ছেন না। হয়ত পরে পাঠাবেন। এই প্রেক্ষিতে সমাধান আনা কিছুটা কঠিন।
তেব নতুন বাজার সৃষ্টির ক্ষেত্রে চেষ্টা আরো বাড়াতে হবে। বিশেষ করে ট্যুরিজম, সেবা, স্বাস্থ্যসহ চাহিদামূলক খাতে কর্মীদের প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে। গদবাঁধা ধারা থেকে বেরিয়ে আরো উচ্চতর প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে আন্তর্জাতিক বাজারে কাজ করার উপযোগী করে তুলতে হবে। কিছুটা কাজ যে হচ্ছে, তা নয়। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে হলে আরো বেশি কর্মী তৈরি করতে হবে। তাহলে কমে আসা রেমিটেন্স পূরণ করা সম্ভব।
এদিকে বিগত কয়েক বছরে উল্লেখ করার মত নতুন কোন শ্রম বাজার পায়নি বাংলাদেশ। উন্মুক্ত হয়নি বন্ধ হওয়া বড় শ্রম বাজারগুলোও। এমন অবস্থায় সরকার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
২ বছরে ৩ লাখ শ্রমিক নেবে কাতার
তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে কাতার সফর করছেন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি। দেশটি আগামী ২ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৩ লাখের বেশি কর্মী নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে বলে জানান তিনি। এক্ষেত্রে সেলসম্যান, নার্স, ডাক্তার, প্রকৌশলী ও অফিস কর্মচারী অগ্রাধিকার পাবে।
কাতার থেকে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে প্রশাসনিক উন্নয়ন ও শ্রম সমাজ বিষয়ক মন্ত্রী ড. ইসা সাদ আল-ফাফালি আল-নুয়াইমি লাদেশি কর্মীদের দক্ষতা ও কর্মনিষ্ঠার প্রশংসা করে আরও বাংলাদেশি কর্মী নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এ লক্ষ্যে আগামী মার্চের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।’
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৩ হাজার কর্মী কাতারে কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়। দেশটিতে ২০২২ সালে অনুষ্ঠেয় ফুটবল বিশ্বকাপ ঘিরে ব্যাপক উন্নয়ন কাজ চলছে।
এছাড়া সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাজারে শুধু গৃহশ্রমিক প্রবেশ করছে। তবে সম্প্রতি সৌদি সরকার নারী শ্রমিকের সঙ্গে একজন করে পুরুষ কর্মীও নিতে রাজি হয়েছে। তবে ব্যাপকভাবে সে কার্যক্রম শুরু করা যায়নি এখনো। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যদেশগুলোর মধ্যে ওমানে শ্রমিক পাওয়া অব্যাহত রয়েছে।