দুই দেশের মধ্যে জঙ্গি নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠার তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের গোয়েন্দারা
2016.08.30

বর্ধমান থেকে গ্রেপ্তার হওয়া মো. মসিউদ্দীন মুসার সঙ্গে শুধু ‘সুলেমান’ নয়, খাগড়াগড়ে আস্তানা গাঁড়া জঙ্গিদের যোগাযোগের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তাদের একজন খাগড়াগড় মামলায় অভিযুক্ত আমজাদ আলী শেখ ওরফে কাজল।
২০১৪ সালে বর্ধমানের খাগড়াগড়ে তৃণমূল কংগ্রেসের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত একটি তিনতলা বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ হয়। ঘটনাস্থলে শোভন মণ্ডল ও শাকিল আহমেদ নামে দুই ব্যক্তি নিহত হন।
ওই ভবন থেকে ৫০টিরও বেশি অবিস্ফোরিত বোমা ও বোমা তৈরির উপকরণ উদ্ধার করে পুলিশ। উদ্ধার হয় মুজাহিদদের পোশাক ও তালেবানদের প্রশিক্ষণের ভিডিও। ওই আস্তানায় বাংলাদেশ ও ভারতের জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্যরা থাকত।
জেএমবি সদস্য আমজাদ আলী শেখের কাজ ছিল খাগড়াগড়ে বোমা তৈরির জন্য বিস্ফোরক ও রাসায়নিক সরবরাহ করা। ভারতের পুলিশ আমজাদের মাথার দাম ধরেছিল ১০ লাখ টাকা। ২০১৪ সালের ১০ নভেম্বর আমজাদকে গ্রেপ্তার করে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)। তারপর থেকে জেলেই আছে আমজাদ।
মুসাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ভারতের গোয়েন্দারা মোটামুটি নিশ্চিত যে, খাগড়াগড়ে বোমা বিস্ফোরণের পর গ্রেপ্তার হওয়া আমজাদের সঙ্গে মুসার যোগাযোগ ছিল।দু’জনেরই বাড়ি বীরভূমে। আমজাদ কীর্ণাহারের ও মুসা লাভপুরের বাসিন্দা। দু’টি জায়গার মধ্যে দূরত্ব ১০ কিলোমিটার।
ভারতীয় গোয়েন্দারা ২০১৪ সালের আগে থেকে ধারণা করে আসছিলেন যে, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো জেএমবি সদস্যদের অভয়ারণ্যে পরিণত হচ্ছে। খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণের পর তদন্তে বেরিয়ে আসে, বর্ধমানের ওই বাড়িটি বাংলাদেশের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির আস্তানা হিসেবে ব্যবহার হচ্ছিল।
পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক মনিরুজ্জামান বেনারকে বলেন, “ঐতিহাসিক কারণেই ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের একটা যোগাযোগ আছে। মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, পশ্চিম দিনাজপুরে বাংলাদেশের মানুষের যাতায়াত আছে। ওদিক থেকে আত্মীয়-স্বজনের কাছে অনেকে আসেন, বৈধ বা অবৈধ পথে। সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ এই সুযোগ নিয়ে থাকতে পারে।”
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা মুর্শিদাবাদ, মালদহ, নদীয়ায় কমপক্ষে সাতটি মাদ্রাসায় কট্টরপন্থী আহলে হাদিস মতাদর্শ অনুসরণের খোঁজ পায়। এসব জায়গায় জেএমবির নেতাদের যাতায়াত থাকার অভিযোগ আছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলোর অবস্থান ভারতের মুর্শিদাবাদ, মালদহ, নদীয়া ও পশ্চিম দিনাজপুর ঘেঁষে।
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. ছানোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের বগুড়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, গাইবান্ধা, রংপুর ও দিনাজপুরের আহলে হাদিস মতাদর্শের বিপুলসংখ্যক মানুষ বসবাস করেন। কট্টরপন্থী এই মানুষদের অনেকেই জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছে”।
খোঁজ নিয়ে জানা যায় কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের হামলায় নিহত আবদুল্লাহর বাড়ি দিনাজপুর। সে ওই অঞ্চলে আহলে হাদিস মতাদর্শ বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার করত।
দিনাজপুরের বাসিন্দা চমন বেগম বেনারকে বলেন, “আবদুল্লাহ গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে এমনকি মেয়েদেরও ধর্মের জ্ঞান দিত। তাদের ভিন্ন কায়দায় সালাওয়াত পড়া শেখাত”।
দুই দেশের পুলিশের জেরায় মুসা বলেছে, তাকে উগ্রবাদের দীক্ষা দিয়েছে বাংলাদেশের জঙ্গিরা।
৬ জুলাই বর্ধমানে মুসা গ্রেপ্তারের পর উপমহাদেশকে কেন্দ্র করে জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক গড়ে উঠছে কি না, তা নিয়ে নতুন করে অনুসন্ধান শুরু করেছে বাংলাদেশ ও ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আমজাদের কাছ থেকে বিস্ফোরক নিয়ে মুসা আইএসের ভারতীয় শাখার জঙ্গিদের যোগান দিত কি না, সে বিষয়েও তদন্ত চলছে।
বাংলাদেশ পুলিশের তিন সদস্যের একটি দল ভারতের জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (এনআইএ) হেফাজতে থাকা মুসাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পেরেছে, আইএসের সক্রিয় সদস্যের তকমা পাওয়া জঙ্গি মুসার সঙ্গে গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলাকারী জেএমবির শীর্ষ নেতাদের যোগাযোগ ছিল।
বাংলাদেশ পুলিশের নবগঠিত ইউনিট কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগে প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, “গুলশান ও শোলাকিয়ায় যারা হামলা চালিয়েছে তাদের সঙ্গে মুসার গুরু কথিত সুলেমানের যোগাযোগ আছে। সুলেমান, দেশের উত্তরাঞ্চলে সংঘটিত আলোচিত একটি হত্যাকাণ্ডের আসামি।”
পুলিশ বলছে, জেএমবি সদস্যরা যেন চাইলেই এপার-ওপার করতে না পারেন সে জন্য সীমান্তের দুই পাশেই নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
এদিকে ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা খাগড়াগড়ের হামলা প্রসঙ্গে জানতে বাংলাদেশে এসে বেশ কয়েকজন জেরা করেছেন। বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাও সম্প্রতি ভারতে গিয়ে কয়েকজন সন্ত্রাসীকে জেরা করে এসেছেন। সন্ত্রাস দমনে এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে উভয় দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় বন্দি বিনিময় সংক্রান্ত যে চুক্তি অনুমোদন হয়েছে, তাতে বলা হয়—এক দেশের নাগরিক অন্য দেশে গিয়ে গ্রেপ্তার হলে আসামি যে দেশের নাগরিক সেই দেশের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ ছাড়া হস্তান্তর করা যাবে। এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের বন্দি বিনিময় সহজ হবে।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ভারতের নয়াদিল্লী থেকে রোহিত ওয়াধওয়ানি এবং গৌহাটি থেকে ঝুমুর দেব।