আনন্দ-আবহে নিষেধের কাঁটায় বাংলা নববর্ষের আহ্বান

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.04.13
160413-Boishakh-620.jpg মঙ্গল শোভাযাত্রা উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইনস্টিটিউটে চলছে বিভিন্ন পশু–পাখি তৈরির কাজ। ১২ এপ্রিল ২০১৬।
ফোকাস বাংলা

তাপস নিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/ ...এসো হে বৈশাখ। রুক্ষ শুষ্ক তাপের দহন, সেই সঙ্গে নানা নিষেধের বেড়াজালের আবহে এল এবারের বৈশাখ।

অন্যান্য বছরের চেয়ে এবারের বর্ষ-আবাহনের আয়োজনে বিধিনিষেধ, সীমাবদ্ধতা, সংকোচন প্রাণের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছলতার প্রবাহে বাধা তৈরি করেছে। এ নিয়ে বিতর্ক জমজমাট। মিডিয়া তোলপাড়।

নিকট অতীতে পহেলা বৈশাখের আনন্দময় দিনে ঘটেছে নারী লাঞ্ছনার মতো অনভিপ্রেত ঘটনা। তারও আগে একবার রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা বিস্ফোরণে ঝরেছে রক্ত। প্রাণ গেছে অনেকের। সেই ক্ষত এখনো রয়ে গেছে কাঁটার মতো।

এবার সম্ভাব্য নাশকতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড রোধের লক্ষ্যে নে​ওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। নিষেধাজ্ঞার কড়াকড়ি সমালোচনার জন্ম দিলেও প্রাণের উত্তাপ যথেষ্টই বিদ্যমান। রকমারি আয়োজনে আচার অনুষ্ঠানে বাঙালির প্রাণের উৎসব নববর্ষ উদ্‌যাপনে উৎসাহ উদ্দীপনা আচার অনুষ্ঠান আয়োজনের কোনো কমতি নেই। বরাবরের মতোই থাকছে ব্যবসায়ীদের হালখাতা, মেলা, রমনা বটমূলে ছায়ানটের সংগীতানুষ্ঠান, চারুকলা অনুষদের আয়োজন-ব্যবস্থাপনায় মঙ্গল শোভাযাত্রা ইত্যাদি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) বলেছে, এবার বিকেল পাঁচটার পরে কোনো খোলা জায়গায় কনসার্ট আয়োজন করা যাবে না। মঙ্গল শোভাযাত্রায় ব্যবহার করা যাবে না মুখোশ, ভুভুজেলা বাজানো নিষিদ্ধ। 
“এইসব বিধিনিষেধ ও পরামর্শ অনুষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের জন্যে দেওয়া হয়নি। বরং সবাই যাতে সুশৃঙ্খলভাবে অনুষ্ঠান করতে পারেন, সে লক্ষ্যেই এগুলো দেওয়া হয়েছে,” গত সোমবার সাংবাদিকদের জানান ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। তাঁর দাবি, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এবার কোনো হুমকি নেই। নেই নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কাও।

গত বছর পহেলা বৈশাখের উৎসবের মধ্যে সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকে একদল ব্যক্তি নারীদের যৌননিপীড়ন করে।দেশজুড়ে সমালোচিত ওই ঘটনার অপরাধী সবাইকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশের ব্যর্থতার মধ্যে এবার অনুষ্ঠানে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে সরকার।
“গতবারের ঘটনায় বিচার না পাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে এবার আমরা নিজেরাই যে কোনো অপতৎপরতা প্রতিহত করব,“ বেনারকে  জানান ছাত্র ইউনিয়নের  সভাপতি লাকী আক্তার।  
নববর্ষের অনুষ্ঠানের সময় কমিয়ে ৫টা পর্যন্ত করায় বছর ধরে এই উৎসবের অপেক্ষায় থাকা অনেকেই এর সমালোচনা করছেন।
বুধবার বিকালে পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে রমনা বটমূলে নেওয়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ শেষে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেন, “নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব মনে করেই কিছু কিছু বিধি-নিষেধ আমরা আরোপ করেছি।”

মূল আয়োজন ছায়ানটের

বৈশাখী সকালে এবার ছায়ানটের শিল্পীরা গাইবেন মানবতার গান। ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানট রমনা বটমূলে  অনুষ্ঠান করে আসছে দীর্ঘ ৪৮ বছর ধরে।  এইবার ছায়ানটের বর্ষ আবাহনের দুই ঘন্টার। অনুষ্ঠানে থাকবে ১৫টি একক গান, ১২টি সম্মেলক গান, তিনটি আবৃত্তি ও পাঠ। সবশেষে ছায়ানট সভাপতি অধ্যাপক ড. সন্‌জীদা খাতুনের শুভেচ্ছা কথনের মাধ্যমে সমাপ্ত হবে এই আয়োজন, সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে। এবারের পুলিশের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “পুলিশ পহেলা বৈশাখে সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা করছে। সে কারণে বিধিনিষেধ দিচ্ছে। আমরা এটার পক্ষে। আমি মনে করি না, সরকারিভাবে পহেলা বৈশাখের আয়োজনকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে।”

মঙ্গল শোভাযাত্রা সমাচার

পহেলা বৈশাখের নান্দনিক ও আকর্ষণীয় উপাদান হলো চারুকলা অনুষদের আয়োজনে মঙ্গল শোভাযাত্রা। শুরু হবে সকাল দশটায়। এবারের প্রতিপাদ্য হলো ‘অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে’। প্রস্তুতি সম্পন্ন। নববর্ষের সূচনাদিনের সকালবেলা যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হবে, তার মূল কাঠামো থাকবে আটটি। এগুলোর মধ্যে ষাঁড় হলো শক্তির প্রতীক, পাখি হচ্ছে প্রকৃতির প্রতীক, নৌকা হলো সমৃদ্ধির প্রতীক,মা ও শিশু হচ্ছে আত্মিক সম্পর্কের প্রতীক। এ ছাড়া থাকছে বিভিন্ন মুখোশ, সরাচিত্র, খরগোশ, বিভিন্ন লোকজ পাখির পেপার কাটিং, পেপার ম্যাশসহ আরও অনেক চোখকাড়া উপাদান ও অনুষঙ্গ। এবারই প্রথম সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাষ্ট্র স্বীকৃতভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হবে।

ক্ষুব্ধ নারী নেত্রীরা

“সরকার মানুষের ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তা দিতে সাংবিধানিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। অথচ বলা হচ্ছে, বিকেল পাঁচটার পরে উন্মুক্ত স্থানে কোনো অনুষ্ঠান করা যাবে না। এ সিদ্ধান্ত মধ্যযুগীয় চিন্তার প্রতিফলন ,” বেনারকে জানান নারী নিরাপত্তা জোটের আহ্বায়ক সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, অবিলম্বে এ সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে।
সুলতানা কামাল বলেন, সময় বেঁধে রাষ্ট্র পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দিল, কোনো কারণে উৎসবের আমেজ, অনুষ্ঠান যদি পাঁচটার মধ্যে শেষ না হয় তাহলে রাষ্ট্র তোমার সুরক্ষার দায়িত্ব নেবে না। ভয়ের সংস্কৃতিকে সমর্থন দেওয়া হলো।
নারী  সাংবাদিক কেন্দ্রসহ বিভিন্ন সংগঠন গতকাল ক্ষোভ প্রকাশ  করেছে  সরকারের  এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।