জঙ্গি আতঙ্ক আর জঙ্গিবিরোধী অভিযানে আটকে গেছে দেশ

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.07.18
160718-BD-cafe-folo-620.jpg বাংলাদেশ র‍্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটেলিয়ান (র‍্যাব) সদস্যদের সতর্কাবস্থান।সোমবার র‍্যাব বগুড়ার দুটি জঙ্গি প্রশিক্ষন কেন্দ্রে হানা দেয়। ছবি, মে ৬,২০১৩।
এএফপি

জঙ্গি আতঙ্ক আর জঙ্গিবিরোধী অভিযান—এর মধ্যে আটকে আছে দেশের সামগ্রিক কর্মকান্ড। গুলশান হামলার পর দুই সপ্তাহ পার হলেও দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি। আরও হামলার আশঙ্কায় এক ধরনের গুমোট ও থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।

গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে তিন শিক্ষকসহ মোট পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁদেরকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

তবে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছ থেকে উধাও হয়ে যাওয়া আবুল হাসনাত রেজাউল করিম ও তাহমিদ হাসিব খানের সন্ধান এখনও পর্যন্ত মেলেনি। তাঁদের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে রহস্য কাটছে না।

গত কয়েকদিন ধরে দেশজুড়ে চলছে জঙ্গি আতঙ্ক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও হামলার আশঙ্কা প্রকাশ করায় মানুষ ভাবছে, আরও ঘটনা ঘটবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।

“এই অবস্থা বেশিদিন থাকবে না। অন্ধকার কেটে যাবে, মৌলবাদি ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী পরাজিত হবেই। কারণ এ দেশের মানুষ উগ্রবাদ পছন্দ করে না,” বেনারকে জানান কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী।

এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া মন্ত্রীসভার সদস্যদের মোবাইল ফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে তাঁদের সতর্ক থাকতে বলেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মন্ত্রী বেনারকে বলেন, “পুলিশ কমিশনারের ক্ষুদে বার্তা পেয়েছি।”

গত দুইদিনে গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচজন হলেন; নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব হেলথ অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সেস অনুষদের ডিন এস এম গিয়াস উদ্দিন আহসান, বসুন্ধরার যে ভবনে তার ফ্ল্যাট সেই ভবনের তত্ত্বাবধায়ক মাহবুবুর রহমান এবং গিয়াস উদ্দিনের ভাগনে আলম চৌধুরী।

এ ছাড়া জঙ্গিদের কাছে বাড়ি ভাড়া দেওয়ায় মিরপুর ১০ নম্বরে অবস্থিত আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম এবং আশুলিয়ার আরেক স্কুল শিক্ষক মিলন হোসাইনকে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এঁদের সবাইকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে গিয়াস উদ্দিন, মাহবুবুর, আলম ও নুরুলকে গুলশানের রেস্তোরাঁয় হামলাকারীদের বাসা ভাড়া দেওয়া এবং তাদের বিষয়ে তথ্য না রাখার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

মিলনকে পাঁচদিনের এবং বাকি চারজনকে আটদিন করে রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে আদালত। এদিকে গ্রেপ্তার হওয়া নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গিয়াস উদ্দিন আহসানকে গতকাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

“বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে,” বেনারকে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগের উপ–পরিচালক বেলাল আহমেদ।

পুলিশ যা বলছে

গত শনিবার গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ সাংবাদিকদের জানায়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও তার দুই সহযোগী এবং সাবেক শিক্ষক নুরুলকে ভাড়াটিয়াদের বিষয়ে তথ্য না রাখার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

কিন্তু রোববার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে রিমান্ড আবেদনের সময় দেওয়া প্রতিবেদনে পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারীদের আশ্রয় দেওয়া এবং হামলা করতে সহায়তা করার অভিযোগ আনে।

রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু আদালতকে বলেন, তাঁরা জঙ্গিদের বাসা ভাড়া দিয়েছেন, কিন্তু ভাড়াটের কোনো তথ্য থানাকে দেননি। বাড়ি ভাড়ার আড়ালে জঙ্গিদের আশ্রয় দিয়ে তাঁরা সহযোগিতা করেছেন।

তিনি বলেন, পুলিশ ভাড়াটেদের কক্ষ থেকে বালুভর্তি কার্টন, পোশাকসহ বিভিন্ন মালামাল জব্দ করেছে। এসব কার্টনে হামলায় ব্যবহার করা গ্রেনেড রাখা হয়েছিল বলে পুলিশের ধারণা।

অন্যদিকে সাভার থেকে গ্রেপ্তার করা মিলনের বাড়ি লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার বেতকিবাড়ি গ্রামে। তিনি আশুলিয়া থানা থেকে দুই কিলোমিটার দূরে পবনারটেক এলাকায় পিয়ার আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষকতা করতেন।

পুলিশের অভিযোগ, হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলায় জড়িত বলে চিহ্নিত পাঁচ জঙ্গির একজন শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল দীর্ঘদিন ঢাকার আশুলিয়ার ভাদাইলে একটি কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকতা করেছেন। মিলন হোসাইন তাঁকে এই চাকরি জোগাড় করে দিয়েছিলেন।

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বেনারকে বলেছেন, “উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে যাতে সেখানে ছাত্র বা শিক্ষক কেউ এ ধরনের কাজে জড়াতে না পারে।”

মন্ত্রী বলেন, কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি জঙ্গিবাদের আশ্রয় দিয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়, তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল করা হবে।”

দোষ স্বীকার করেননি

সোমবার ছিল রিমান্ডের প্রথম দিন। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটি) ইউনিটের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জিজ্ঞাসাবাদে গিয়াসউদ্দিন আহসান ও নুরুল ইসলাম দুজনেই জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন।

পুলিশ বলছে, তারা নিশ্চিত গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার আগে তারা বসুন্ধরা ও শেওড়াপাড়ায় অবস্থান করেছে। ওই হামলায় আরও কেউ জড়িত ছিল কি না, বা তাদের মদদদাতা কে খুঁজে বের করতে অভিযান চলবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

বগুড়ায় জঙ্গি বিরোধী অভিযান

বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলায় জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে, এমন তথ্যের ভিত্তিতে রোববার রাত ১১টা থেকে সোমবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ১৬ ঘণ্টার অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। জঙ্গিবিরোধী ওই অভিযানে অংশ নেন র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং পুলিশের ৪৫০ জন সদস্য। অভিযানে অভিযানে নয়টি জিহাদি বই, তিনটি চাপাতি, তিনটি ছুরি এবং একটি তারের কুণ্ডলী পাওয়া গেছে।

র‍্যাব বলছে, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে বগুড়ার সারিয়াকান্দির দুর্গম চর কাজলা ও ধুনটের নিমগাছি ইউনিয়নে এই অভিযান চালানো হয়।র‍্যাবের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকায় এ অভিযান পরিচালনা করা হয়।

র‍্যাবের পুরস্কার ঘোষণা

অভিযান শেষে বিকেল চারটায় কাজলার টেংরাকুড়ায় শাহজালাল বাজার আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাঠে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে র‍্যাবের মহাপরিচালক জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের মতো নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন থেকে কেউ ফিরে আসতে চাইলে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দেন।

তিনি বলেন, ফিরে আসা ব্যক্তিকে সামাজিকভাবে পুনর্বাসনে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে। আর জঙ্গি আস্তানা বা জঙ্গিদের বিষয়ে যে কেউ তথ্য দিলে তাকে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। সন্ধানদাতার পরিচয় গোপন রাখা হবে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতি

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক হাসনাত রেজাউল করিম ও কানাডার অধিবাসী তাহমিদ হাসিব খানের সব অধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।

গত শুক্রবার এইচআরডব্লিউ এর এশিয়ার পরিচালক ব্রায়াড এডামস এক বিবৃতিতে এই আহ্বান জানান।

জিম্মিদশা থেকে উদ্ধারের পর হাসনাত রেজা করিম ও ব্যবসায়ী পুত্র তাহমিদ হাসিব খানকে ফিরে পায়নি পরিবার। তাদের বিষয়ে এইচআরডব্লিউর এশিয়ার পরিচালক ব্রায়াড এডামস এক বিবৃতিতে বলেছেন, হাসনাত রেজা ও তাহমিদ হাসিব খানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কর্তৃপক্ষ নিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগও আনা হয়নি আবার ছেড়েও দেওয়া হয়নি। আটকের পর থেকে পরিবারের কাছে তাদের বিষয়ে কোনও তথ্য নেই।

বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পুলিশি হেফাজতে ভয়ংকর নির্যাতনের রেকর্ড রয়েছে। আইন অনুসারে এই দুই ব্যক্তির আইনজীবী পাওয়া এবং ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করার অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষকে তাদের এইসব অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।