গ্রেপ্তার হওয়া ভারতীয় নাগরিক মুসার সঙ্গে আইএস ও জেএমবির সম্পৃক্ততা

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.08.25
20160726-ISIS-Flag620.jpg রাজধানীর কল্যাণপুরের একটি ‘জঙ্গি আস্তানায়’ পুলিশ অভিযান চালালে নয় জঙ্গি নিহত হয়,যাদের সাথে ‘আইএস’ সম্পৃক্ততার আলামত পাওয়া যায়। জুলাই ২৫, ২০১৬।
ডিএমপি

আইএসের সক্রিয় সদস্যের তকমা পাওয়া সন্দেহভাজন জঙ্গি মোহাম্মদ মসিউদ্দীন ওরফে আবু মুসার(২৫)সঙ্গে গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলাকারী জেএমবির শীর্ষ নেতাদের যোগাযোগ ছিল। বাংলাদেশ পুলিশের তিন সদস্যের একটি দল ভারতের জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (এনআইএ) হেফাজতে থাকা মুসাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এ তথ্য জানতে পারে।

জঙ্গি ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় গঠিত পুলিশের নবগঠিত ইউনিট কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগে প্রধান মনিরুল ইসলাম ভারতে গিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে মুসাকে জেরা করার কথা নিশ্চিত করেছেন।

পুলিশের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মুসা আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সদস্য এবং বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহেদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) নেতাদের সঙ্গেও তার যোগাযোগ আছে।

গত ৬ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম রেলস্টেশন থেকে মুসাকে গ্রেপ্তার করে বীরভূম জেলা পুলিশ। মৌলবাদী তৎপরতা চালানোর অভিযোগে বেশকিছুদিন ধরে ভারতীয় পুলিশ তাকে খুঁজছিল। বর্ধমানের পুলিশ সুপার কুণাল আগরওয়াল তাকে আটক করেন।

মুসার কাছ থেকে ১৩ ইঞ্চি লম্বা একটি ছুরি, তিনটি গুলি ও একটি দেশি বন্দুক উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর তাকে সিআইডির সদর দপ্তর কলকাতার ভবানী ভবনে নেওয়া হয়। সেখানে সিআইডি, এনআইএ ও আইবির গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।

“সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেসব জঙ্গি হামলা হয়েছে, সে সম্পর্কে মুসার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। মুসা বলেছে জেএমবির কয়েকজন নেতা তাকে মৌলবাদে উদ্বুদ্ধ করে ও হামলা চালানোর টার্গেট ঠিক করে দেয়,” বেনারকে জানান মনিরুল।

সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মুসার সঙ্গে জেএমবি নেতা সুলেমানের পরিচয় ছিল, যে গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার সঙ্গে জড়িত। হামলার পরপরই সুলেমান বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়েছে।

পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান বেনারকে বলেন, “জেএমবি সদস্যদের কেউ কেউ মালদহ, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম দিনাজপুরের মতো জায়গায় পালিয়ে থাকতে পারে। সাংগঠনিকভাবে তারা বিভিন্ন নাম ব্যবহার করে।এতে করে তারা মূল নামে করা পাসপোর্ট ব্যবহার করে পালিয়ে যেতে পারে।”

এ বিষয়টি কীভাবে ঠেকানো যায়, তা নিয়ে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশের কথা হয়েছে বলে জানান মনিরুজ্জামান।

বাংলাদেশ পুলিশের জেরা

বাংলাদেশ পুলিশের তিন সদস্যের একটি দল গত ১৫ আগস্ট কলকাতায় পৌঁছান। ১৬ আগস্ট বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০টা ও ১৭ আগস্ট ভোর ৫টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত দলের সদস্যরা এনআইএ হেফাজতে থাকা মুসার সঙ্গে কথা বলেন।

সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশের পুলিশ জেএমবির কয়েকজন পলাতক আসামির ছবি সঙ্গে নিয়ে ভারতে যান। তাঁরা মুসার কাছে ছবিগুলোর পরিচয় জানতে চান। মুসা একজনকে সুলেমান বলে চিহ্নিত করেছে। তবে আবু সুলেমানের আসল নাম কী, তা তদন্তের খাতিরে বাংলাদেশ পুলিশ আপাতত গোপন রাখতে চাইছে।

এ বিষয়ে মনিরুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, “এখনও তদন্ত শেষ হয়নি। তদন্ত শেষ হলে হামলার বিভিন্ন পর্যায়ে কোন কোন ব্যক্তি কীভাবে জড়িত ছিল, সে সম্পর্কে জানা যাবে।” তিনি আরও বলেন জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত প্রত্যেক ব্যক্তিরই একাধিক নাম রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে জেএমবি নেতারা কীভাবে ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে ও জঙ্গি কার্যক্রমে জড়াচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান মনিরুল।

এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মো. মাসুদুর রহমান বেনারকে বলেন, “জেএমবিসহ জঙ্গি সংগঠনের কোনো নেতা-কর্মী যেন সীমান্ত অতিক্রম করতে না পারে সে জন্য স্থল, নৌ ও বিমানবন্দরগুলোকে সতর্ক করা হয়েছে।”

কে এই মুসা?

পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মোহাম্মদ মসিউদ্দীন ওরফে আবু মুসার জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায়। তবে তার লেখাপড়া ও বেড়ে ওঠা তামিলনাড়ুর তিরুপুরের লুফপুরে। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর মুসা ডিগ্রিতে ভর্তি হয়। কিন্তু পড়ালেখা শেষ করেনি সে এবং তার কোনো নির্দিষ্ট পেশা নেই। যখন যে কাজ পায়, তা-ই করে।

গত ৬ জুলাই গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রথমে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অপরাধ দমন শাখা বা সিআইডি এবং পরে ভারতের জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (এনআইএ) জেরায় মুসা জানায়, ‘ইসলামিক স্টেট বাংলাদেশ’ নামে একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ২০১৪ সালে সুলেমানের সংস্পর্শে আসে মুসা। আইএসের হয়ে কাজকর্ম চালানোর জন্য মুসাকে বিভিন্ন সময় উদ্বুদ্ধ করেছে সুলেমান।

পুলিশ জানায়, জেএমবির ওই নেতার নাম সুলেমান কি না সে সম্পর্কে কিছু জানা না গেলেও, ওই ব্যক্তি আইএসের তত্ত্ব, তথ্য, অডিও, ভিডিও প্রচার ও তাদের মুখপাত্র দাবিক এর অনুবাদ করে সাধারণ মুসলমানদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করত। তার সঙ্গে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় হামলার আগে মুসার দেখা হয়েছে বলে মুসা জিজ্ঞাসাবাদে জানায়।

পুলিশের প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে মুসা জানিয়েছে, বাংলাদেশের জেএমবি সদস্যরা তাকে শ্রীনগরে বিদেশিদের খুনের দায়িত্ব দিয়েছিল। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতেই তাকে খুন করতে উদ্বুদ্ধ করে বাংলাদেশের জঙ্গিরা।

পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, আইএস মতাদর্শীরা ভিন্ন মতাবলম্বী, ভিন্ন ধর্মের মানুষকে যেমন খুন করতে চায় জেএমবিও তাই চাইছে। এমনকি তারা সুফি সাধক, পীর, দরবেশ, ওলামা-মাশায়েখদেরও শত্রু মনে করে এবং সুফিবাদকে অধর্ম মনে করে।

মনিরুল আরও বলেন, তিন সদস্যের প্রতিনিধি দলে রাজশাহী জেলার গোয়েন্দা বিভাগের একজন প্রতিনিধিও ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিমের খুনিদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে তাঁকে দলে নেওয়া হয়। যেসব তথ্য পাওয়া গেছে সেগুলো এখন যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

তিনি জানান, মুসাকে জেরা করে পুলিশ আরও ১২ জন অনুসরণকারীর নাম পেয়েছে। তাদের মধ্যে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

পুলিশ সূত্রে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই’য়ের সঙ্গেও তার যোগাযোগ রয়েছে।

ভারতের গণমাধ্যম সূত্রে আরও জানা গেছে, সোমবার মুসা চেন্নাই থেকে ট্রেনে করে হাওড়ায় যায়। সেখান থেকে ধর্মতলায় এসে ধারালো অস্ত্র কিনে সে নিজের গ্রামের বাড়ি লাভপুরে যাচ্ছিল। মুসার পিছু নেয় ভারতের গোয়েন্দারা। বর্ধমান রেলস্টেশনে ওই জঙ্গি ধরা পড়ে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।