সাত চা বাগান অধিগ্রহণের পথে আইনি বাধা মালিক গোষ্ঠীর

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2016.02.01
Ind-teagarden ভারতের উত্তরবঙ্গের চা শ্রমিকরা বকেয়া মজুরি পাচ্ছেন না, অনাহারে-অপুষ্টতে ভুগছেন, অনেকে মারাও গেছেন।
অনলাইন

উত্তরবঙ্গের সাত চা বাগানের সাড়ে সতেরো হাজার কর্মীর মুখে কি শেষ অবধি হাসি ফুটবে?
গত সপ্তাহের শেষে এই প্রশ্নের উত্তরে যতখানি নিশ্চিত ভাবে হ্যাঁ বলার অবস্থা তৈরি হয়েছিল, আজ সোমবার তাতে ফের অনিশ্চয়তার মেঘ।

কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রী নির্মলা সীতারামন গত সপ্তাহের শেষে জানিয়েছিলেন, গৌরীপ্রসাদ গোয়েঙ্কার মালিকানাধীন ডানকান লিমিটেড পরিচালিত চা বাগানগুলির মধ্যে সাতটিকে অধিগ্রহণ করছে কেন্দ্রীয় সরকার। ১৯৫৩ সালের ভারতীয় চা আইনের ধারা উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছিল, ডানকান যে ভাবে বাগানগুলি চালাচ্ছিল, তা চা শিল্পের জন্য যেমন ক্ষতিকর, বৃহত্তর সমাজের পক্ষেও তেমনই খারাপ। বাগানগুলির পরিচালনার মানের উন্নতির জন্যই কেন্দ্রীয় সরকার সেগুলিকে অধিগ্রহণ করছে।

অধিগৃহীত বাগানগুলির মোট কর্মীসংখ্যা ১৭৫৫৫ জন। তার মধ্যে বীরপুরা চা বাগানে কর্মীর সংখ্যা ৩৯৩৭, গারগন্ডা চা বাগানে ১৭৭৭, লঙ্কাপাড়া চা বাগানে ২৯১৯, তুলসিপাড়া চা বাগানে ১৭৩৭, হান্তাপাড়া চা বাগানে ২২৯৫, ধুমচিপাড়া চা বাগানে ২৫৮৪, এবং ডেমডিমা চা বাগানে ২৩০৬।

এমনিতেই তাঁদের মজুরি যৎসামান্য। সেই টাকাও বকেয়া পড়ে ছিল বহু দিন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা কোনও পরিকাঠামোই না থাকায় কার্যত অনাহারে মারা যেতে বসেছিলেন শ্রমিকরা। বস্তুত, এই সাতটি বাগান যখন অধিগৃহীত হচ্ছে, তখনই অন্য দুটি চা বাগানে মারা গেলেন আরও দুই চা-শ্রমিক। গত দশ মাসে চা বাগানের শ্রমিক পরিবারে অনাহার-অপুষ্টিতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৬৮ জনে।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্বেগের তালিকাতেও বার বার উঠে এসেছে উত্তরবঙ্গের চা বাগানগুলির কথা। গৌরীপ্রসাদ গোয়েঙ্কার সঙ্গে তাঁর আলোচনাও হয়েছে। শ্রমিকদের মাইনে বকেয়া থাকছে কেন, তা নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশি তদন্তের কথাও শোনা গিয়েছিল কয়েক মাস আগে।

কিন্তু, শেষ অবধি সে রকম কিছু হয়নি। তবে, উত্তরবঙ্গ সফরে এসে মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশে চা শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার আবেদন করেছিলেন। তাঁর সেই কথার সুর ধরেই উত্তরবঙ্গ সফরে এসেছিলেন নির্মলা সীতারামন। এবং, শেষ অবধি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হল।

তবে, অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে ডানকান। আজ সংস্থাটি জানিয়েছে, কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি পথেই হাঁটবে তারা। সংস্থার এক প্রতিনিধি বেনার নিউজকে জানান, যখন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সংস্থার কর্ণধারের আলোচনা চলছিল, তখনই এই সিদ্ধান্ত দুর্ভাগ্যজনক। গোয়েঙ্কা নিজেও বলেন, এই সিদ্ধান্তে তিনি বিস্মিত।

ডুয়ার্স অঞ্চলে অবশ্য বিস্ময়ের লেশমাত্র নেই। অঞ্চলের একটি ছোট চা বাগানের তরুণী মালকিন মাম্পি পাল বললেন, সত্যিই চা শ্রমিকদের অবস্থা চোখে দেখা যায় না। তার দায় বড় বাগানগুলিরই। তারাই চায়ের বাজারটাকে এমন ভাবে নষ্ট করে রেখেছে যে আমাদের মতো ছোট বাগানের পক্ষে লাভজনক ভাবে ব্যবসা করা অসম্ভব। ফলে, আমরা বেশি শ্রমিক নিয়োগও করতে পারি না, তাঁদের যথেষ্ট মাইনেও দিতে পারি না। শ্রমিকরা কার্যত অনাহারে মরছেন। কেন্দ্রীয় সরকার দায়িত্ব নিলে পরিস্থিতি যদি পাল্টায়, তা হলেই শ্রমিকরা বাঁচতে পারেন।

কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী বললেন, যত দ্রুত সম্ভব, বাগান চালু করে শ্রমিকদের নিয়মিত মাইনে দেওয়াই তাঁদের প্রথম লক্ষ্য। এখন থেকে তাঁরা নিয়মিত মাইনে পাবেন। তবে, বকেয়া বেতনের দায় নেবে না কেন্দ্রীয় সরকার। এই সাতটি চা বাগানে শ্রমিকদের মজুরি বাবদ বকেয়া রয়েছে প্রায় সত্তর কোটি টাকা।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় সরকারের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বললেন, যদি সত্যিই বাগানগুলিকে ফের ঠিক ভাবে চালু করা যায়, তা খুবই ভাল। তবে, শ্রমিকরা যাতে তাঁদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত না হন, সরকারকে তা নিশ্চিত করতে হবে।

কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকের এক উচ্চপদস্থ কর্তা জানালেন, বাগানগুলি পরিচালনার ভার আপাতত থাকছে টি বোর্ড নামক কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থার হাতে। চা বাগান চালানোর অভিজ্ঞতা আছে, এমন কোনও বেসরকারি সংস্থাকে বাগান পরিচালনার কাজে নিয়োগ করার পরিকল্পনাই রয়েছে। প্রসঙ্গত, গোটা দুনিয়ায় দার্জিলিং চায়ের কদর, উচ্চ মানের চায়ের দামও আন্তর্জাতিক বাজারে যথেষ্ট। এই সাতটি বাগান যদি পুরোদস্তুর চালু হয়, তবে বছরে এক কোটি কিলোগ্রাম চা উৎপাদন করার ক্ষমতা রয়েছে।

বলাই বাহুল্য, চা বাগান অধিগ্রহণের সিদ্ধান্তটি যতখানি বাণিজ্যিক বা অর্থনৈতিক, তার চেয়ে ঢের বেশি রাজনৈতিক। আর কয়েক মাসের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। শাসক তৃণমূল কংগ্রেস যেমন চা বাগানের আবেগ উস্কে দিয়ে উত্তরবঙ্গের ভোটারদের মন জিততে চাইছেন, বিজেপি-রও তাই ইচ্ছা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক সঞ্জয় শিকদার বললেন, এই ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবে তৃণমূল কংগ্রেসই। সত্যিই বাগানগুলি চালু হলে, শ্রমিকরা নিয়মিত মজুরি পেলে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করার সুবাদে কৃতিত্বের দাবিদার হবেন মুখ্যমন্ত্রী। আর, কোথাও গোলমাল হলে, পরিকল্পনাটি ঠিক ভাবে বাস্তবায়িত না হলে গোটা দোষটাই কেন্দ্রীয় সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যাবে!

তবে, এই মুহূর্তে প্রধানতম প্রশ্ন হল, আইনি জট কাটিয়ে সত্যিই কি কেন্দ্রীয় সরকার অধিগ্রহণ করতে পারবে বাগানগুলিকে? সত্যিই ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’-র চা বাগানে প্রাণের স্পন্দন ফিরবে?

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।