নারায়ণগঞ্জে নিহত ৩ জঙ্গির বিরুদ্ধে মামলা,শিগগিরি বড় অভিযানের প্রস্তুতি

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.08.29
160829-3Militants-Bodies1000.jpg নারায়ণগঞ্জে নিহত তিন জঙ্গির মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের মর্গে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। আগস্ট ২৭, ২০১৬।
নিউজরুম ফটো

নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের ঘটনায় নিহত তিনজন সহ অজ্ঞাত পরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা করেছে পুলিশ। নারায়ণগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসাদুজ্জামান রোববার সকালে ওই মামলা দায়ের করেন।

নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) ফারুক হোসেন বেনারকে বলেন, “সন্ত্রাস বিরোধী আইনে দায়ের হওয়া মামলায় ‘নব্য জেএমবি’র শীর্ষ নেতা তামিম আহমেদ চৌধুরীর নাম উল্লেখ করে মামলা হয়েছে। বাকি দুজনকেও আসামির তালিকায় রাখা হয়েছে।”

তিনি জানান, বাকি দুজনের নাম সেখানে লেখা হয়নি। এ ছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় ‘আরও অনেককে’ এজাহারে আসামি করা হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়া জঙ্গি আস্তানা থেকে অস্ত্র, গোলা-বারুদসহ ২৪ ধরনের আলামত জব্দ করেছে পুলিশ। এই তালিকায় মেড ইন ইউএসএ খোদাই করা একটি একে-২২ রাইফেল, ৭.৬৫ বোরের কাঠের বাঁটযুক্ত দুটি পিস্তল, তিনটি চাপাতি, বিস্ফোরিত গ্রেনেডের অংশ, বাইনোকুলার পাওয়া গেছে।

নিহত তিন জঙ্গির ময়নাতদন্ত রোববার ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের মর্গে সম্পন্ন হয়েছে।তিন জঙ্গির মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে রয়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ বেনারকে বলেন, “নিহত তিনজনেরই মৃত্যু হয়েছে গুলিবিদ্ধ হয়ে। তামিম ছাড়া বাকি দুজনের দেহে বোমার স্প্লিন্টার পাওয়া গেছে। একজনের পায়ের কিছুটা অংশ বোমের আঘাতে উড়ে গেছে।”

পুলিশ সুপারের সংবাদ সম্মেলন

বিদেশি নাগরিকদের ওপর হামলা করতে নারায়ণগঞ্জে জঙ্গিরা ঘাঁটি গেড়েছিল বলে দাবি করেছেন নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) মঈনুল হক। তিনি বলেন, গত ২ জুলাই ওষুধ ব্যবসায়ী পরিচয়ে দুজন ওই বাড়িটি ভাড়া নেয়। ওই দুজন ছাড়াও আরও একজন তাদের সঙ্গে থাকা শুরু করে। ভাড়াটেরা তাদের ফ্ল্যাটে কাউকে ঢুকতে দিত না। থানায় ভাড়াটেদের তথ্য দেওয়ার কথা থাকলেও বাড়ির মালিক তা দেননি। এ ঘটনার পর এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

এদিকে শনিবার রাতে পুলিশ নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়া এলাকা থেকে জিহাদি বইসহ শিবির নেতা ইব্রাহিম খলিলকে গ্রেপ্তার করেছে। নিহত জঙ্গিদের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা আছে কি না, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে জানায় পুলিশ।

পরিচয় প্রকাশ করেনি এখনো পুলিশ

তামিম আহমেদ চৌধুরী ছাড়া বাকি দুই জঙ্গির পরিচয় এখনো পুলিশ নিশ্চিত করেনি। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া ও গণসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বেনারকে বলেন, “আমরা আঙুলের ছাপ নিয়ে পরিচয় নিশ্চিত করি। শনিবার সরকারি ছুটি হওয়ায় জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভান্ডারে সংরক্ষিত আঙুলের ছাপের সঙ্গে নিহত জঙ্গিদের হাতের ছাপ মেলানো সম্ভব হয়নি”

তিনি জানান, সময়ের সাথে মৃতদেহে পরিবর্তন আসতে থাকায় আঙুলের ছাপের সঙ্গে তথ্যভান্ডারে রাখা আঙুলের ছাপ মেলেনি। তবে একজনের পরিচয় জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে ও পরিবারের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তার নাম ফজলে রাব্বী।

রাব্বী যেভাবে জঙ্গি হয়

ফজলে রাব্বীর বাবা যশোরের কিসমত নওয়াপাড়ার বাসিন্দা উপশহর ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মো. হাবিবুল্লাহ। রাব্বী যশোর সরকারি এমএম কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানের ২য় বর্ষের ছাত্র ছিল। সে জিহাদে যাওয়ার কথা বলে গত ৫ এপ্রিল বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।

মো. হাবিবুল্লাহ ৭ এপ্রিল ছেলে নিখোঁজ হওয়ার তথ্য জানিয়ে যশোর কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। তার বাবা স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, “ছবি দেখে চিনলাম ও আমার ছেলে।”

প্রতিবেশীরা জানান, জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে রাব্বীর প্রায়ই ঝগড়া-বিবাদ হতো। এলাকায় তার বন্ধু-বান্ধব খুব একটা ছিল না। জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় তার বাড়িতে র‍্যাব-পুলিশের নজরদারি ছিল।

গত ঈদের দিন পুলিশ ও র‍্যাব সদস্যরা ফজলে রাব্বীর বাড়িতে গিয়ে তার সম্বন্ধে তথ্য জানার চেষ্টা করেছিল। গুলশান হামলার পর যশোর পুলিশ নিখোঁজ যে পাঁচজনের ছবি দিয়ে পোস্টার ছাপিয়েছিল, সেখানে ২ নম্বরে রাব্বীর ছবি ছিল।

অপর তরুণের নাম তাওসীফ

পুলিশ এখনো আনুষ্ঠানিক ওই অভিযানে নিহত অপর তরুণের নাম প্রকাশ না করলেও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ অপর তরুণের নাম তাওসীফ হোসেন। ধানমন্ডির বাসিন্দা তাওসীফ হোসেন, নিবরাস ইসলাম ও শেহজাদ রউফ অর্কের মতো একই দিনে বাড়ি ছেড়েছিল।

গত ৩ ফেব্রুয়ারি বাড়ি ছাড়ার সময় তাওসীফ পরিবারকে জানায়, সে নিবরাসের সঙ্গে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় তার সঙ্গে ছোট একটা ব্যাগ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। নিবরাজ ও তাওসীফ দুজনেই মালয়েশিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

এ বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি তাওসীফের মালয়েশিয়া ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। প্লেনের টিকিটও কাটা হয়েছিল। তাওসীফের বাবা আজমল হোসেন একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি বা তাঁর পরিবারের আর কেউ লাশ শনাক্তের ব্যাপারে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।

গত ১ জুলাই গুলশানের ক্যাফেতে হামলার আগে ঢাকার এই দুই তরুণই ঝিনাইদহের একটি মেসে ছিল বলে জুলাইয়ের শেষদিকে জানিয়েছিলেন জঙ্গি-তদন্তে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাওসীফের ফুপাতো ভাই আহমেদ শাম্মুর রাইয়ান একবার আইএসে জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার হয়েছিল বলে জানা জায়। স্কলাস্টিকার সাবেক ছাত্র শাম্মুরও মালয়েশিয়ায় পড়ত।

গুলশান হামলায় আরও সন্দেহভাজন চিহ্নিত

গুলশান হামলার নেপথ্যের আট-নয়জনকে চিহ্নিত করার কথা জানিয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জে নিহত তামিম চৌধুরী ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

তামিমের আগে কল্যাণপুরে চারজন সমন্বয়ক নিহত হওয়ার পরও জেএমবির নতুন শাখাটি নিশ্চিহ্ন হবে না। তবে তাদের কার্যক্রম স্তিমিত হবে বলে মনে করছে পুলিশ।

মনিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “জেএমবির আধ্যাত্মিক দুই গুরুর একজন আগেই অন্তর্দ্বন্দ্বে খুন হয়েছেন। মাওলানা সাইদুর রহমান জেলে থেকে দল চালাতে চাইছিলেন। নজরুল তা মেনে নিতে পারেননি। এ নিয়ে কলহের জেরে তিনি খুন হন। এরপর পুলিশি অভিযান তো চলছেই।”

একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আরেকটি সক্রিয় জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কথিত সামরিক শাখার প্রধান বরখাস্ত হওয়া মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ও জেএমবির নুরুল ইসলাম মারজানকে ধরতে পারলে সামগ্রিকভাবে জঙ্গিদের থামানো যাবে। দ্রুতই এ দুজনের চ্যাপ্টারও ক্লোজ করে দিতে চায় পুলিশ।

পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নতুন জেএমবির একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে তাঁরা ময়মনসিংহ থেকে ধরতে পেরেছেন, যার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গত শনিবার নারায়ণগঞ্জে ওই অভিযান চালানো হয়।

“তাঁর কাছ থেকে নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সম্পর্কে তথ্য মিলেছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে বড় অভিযানের প্রস্তুতিও রাখা হয়েছে,” বেনারকে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।