বন্ধ ঘোষণার পর নতুন নামে ‘পীস’ স্কুলগুলো চালানোর তৎপরতা
2016.08.03
শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশের অনুমোদনহীন পীস স্কুলগুলো বন্ধের নির্দেশ দেওয়ার পর এখন নাম পরিবর্তন করে এসব বিদ্যালয় আবারও পরিচালনার তৎপরতা শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে কোথাও কোথাও আগের নাম মুছে নতুন নামে স্কুল চালু হয়েও গেছে। আবার কোথাও কোথাও প্রস্তাবিত নাম নিয়ে আলোচনা চলছে।
সরকারের নিবন্ধিত একমাত্র রাজধানীর লালমাটিয়ার ‘পীস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’ এর নিবন্ধন বাতিলের পর এখন এটির নাম ‘সাউথ শোর স্কুল’ করা হচ্ছে বলে অভিভাবকদের আশ্বস্ত করছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।
বেশ কিছুদিন ধরেই ‘পীস’ স্কুলগুলোর কার্যক্রম নিয়ে বিতর্ক চললেও সম্প্রতি দেশে কয়েকটি বড় জঙ্গি হামলার পর এ প্রসঙ্গ আবারও সামনে আসে। অভিযোগ উঠেছে, এসব স্কুলের অনেকগুলো জামায়াতে ইসলামীর আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা ও রাজনৈতিক আদর্শে পরিচালিত হচ্ছে।
এসব স্কুলের পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা। আবার কোনো কোনো স্কুল পরিচালনা পর্ষদে চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন পদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মী-সমর্থকেরাও রয়েছেন।
ঢাকা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর, নোয়াখালী, ফেনীসহ বিভিন্ন জেলায় নামে-বেনামে পরিচালিত পীস স্কুলগুলোকে জামায়াত-শিবির সাংগঠনিক কাজে ব্যবহার করছে সন্দেহ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গত ১৩ মার্চ একটি প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সঠিক সংখ্যা না থাকলেও সারা দেশে পীস নামে শতাধিক বিদ্যালয় রয়েছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।
গুলশানের হলি আর্টিজান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর বাংলাদেশ সরকার ভারতের ইসলামিক বক্তা জাকির নায়েকের উদ্যোগে চালু পীস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। তখন থেকেই পীস স্কুলের নাম পরিবর্তনের তোড়জোড় শুরু হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের পর এই তৎপরতা আরও বেড়েছে।
প্রথমে রাজশাহীতে ‘পীস স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ এর নাম পরিবর্তন করে ‘লিজেন্ড একাডেমি’ করা হয়। তবে কার্যক্রম একই রয়েছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে নগরের তেরখাদিয়া এলাকায় ‘পীস স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ চালু করা হয়। প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে কলেজ শব্দটি যুক্ত থাকলেও কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়নি।
“প্রায় এক মাস আগে ‘পীস’ নামটি নিয়ে যখন বিতর্কের সৃষ্টি হয় তখনই আমরা প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে ‘লিজেন্ড একাডেমি’ রেখেছি,” বেনারকে জানান প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী কর্মকর্তা তৌফিকুর রহমান।
এর মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত মঙ্গলবার ‘পীস’ নামে চালু দেশের অনুমোদনহীন স্কুলগুলো বন্ধের নির্দেশ দেয়। একই সঙ্গে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে ঢাকার লালমাটিয়ায় অবস্থিত ‘পীস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’-এর নিবন্ধন বাতিল করতে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডকে নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সাময়িক নিবন্ধন পাওয়ার পর গত মঙ্গলবারই ঢাকার লালমাটিয়ায় অবস্থিত ‘পীস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’-এর নিবন্ধন বাতিল করে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড।
ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের তিনজন কর্মকর্তা বুধবার বিকেলে স্কুলটির বর্তমান অবস্থান দেখতে যান। অন্য কোনো নামে বিদ্যালয়টি পরিচালনা করা হচ্ছে কি না তাঁরা মূলত সেটি দেখতে যান। মাহবুবুল আলম মৃধা নামে একজন উপ বিদ্যালয় পরিদর্শক সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। এর বাইরে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বর্তমানে ঢাকাস্থ লালমাটিয়ার ‘পীস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’টি বন্ধ থাকায় কর্তৃপক্ষের কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
“আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে ‘সাউথ শোর স্কুল’ নামে স্কুলটি আবারও চালানো হবে। কিন্তু তারপরও আমাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা কাজ করছে। কারণ স্কুলটি না চললে বছরের মাঝামাঝি সময়ে সন্তানের ভর্তি নিয়ে বেকায়দায় পড়বেন,” বেনারকে জানান এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক নূরুল হুদা।
অভিভাবকেরা জানিয়েছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ৩ ও ৪ আগস্ট স্কুলটি ছুটি ঘোষণা করা হয়। সাপ্তাহিক ছুটি শেষে ৭ আগস্ট খোলা হবে। তখন হয়তো নতুন নামেই স্কুলটি চলবে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, শিক্ষার্থীদের দায় ‘তাদেরই’ নিতে হবে। গতকাল বুধবার ঢাকার সিরডাপে এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পীস স্কুল কর্তৃপক্ষকে উদ্দেশ্য করে বলেন, শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব তারাই নেবেন যারা তাদের (শিক্ষার্থীদের) এই পথে নিয়ে এসেছেন।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পীস স্কুলে যে লেখাপড়া হচ্ছে, পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে, মানসিকতা গড়ে তোলা হচ্ছে এটি নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জন্য, দেশের জন্য কখনো মঙ্গলকর নয়। তাঁর মতে, ওই প্রতিষ্ঠানগুলো যাঁরা পরিচালনা করছেন, তাঁরা স্বাধীনতার চেতনার বিরোধী শক্তি।
“তাঁরা এখানে এমনই মনোভাব তৈরি করছেন, যেগুলো জঙ্গিবাদ তৈরির ক্ষেত্রে, ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বিপথগামী করতে উৎসাহিত করে। এ জন্য এ ধরনের প্রতিষ্ঠান আমরা চালাতে দিতে পারি না,” বলেন নুরুল ইসলাম নাহিদ।
ঢাকার বাইরেও ‘পীস’ নামে চালু বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের তৎপরতা চলছে। ২০১৪ সালের শেষের দিকে ঠাকুরগাঁও শহরের পূর্ব গোয়ালপাড়ায় পীস স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয়। এখানে বর্তমানে দেড়শরও বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে।
গত মঙ্গলবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের পর বিদ্যালয়টি অনিবার্য কারণের কথা বলে ৩ আগস্ট থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডও তুলে ফেলা হয়েছে।
“ছুটির মধ্যে নাম পরিবর্তন করে আবার স্কুলের কার্যক্রম শুরুর চেষ্টা চালানো হবে। ইতিমধ্যে নতুন নামের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে,” বেনারকে জানান কলেজের অধ্যক্ষ দীপক চন্দ্র পাল।
এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মূকেশ চন্দ্র বিশ্বাস বলেছেন, “পীস স্কুলের কর্তৃপক্ষ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তাদের বলে দেওয়া হয়েছে, পীস নামের স্কুল বন্ধের বিষয়ে সরকারের যে আদেশ রয়েছে, তা মানতে হবে। ভিন্ন নামে পরিচালনার বিষয়টি সরকারি নীতিমালার আলোকে দেখা হবে।”