বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নাশকতা হলে কঠোর শাস্তি,মন্ত্রিসভায় আইন অনুমোদন
2016.08.08

শতবর্ষেরও বেশি সময় পর সরকার বিদ্যুৎ আইনের সংস্কার করেছে, যেখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, উপকেন্দ্র বা এ ধরনের স্থাপনায় নাশকতার দায়ে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে ১৯১০ সালে বিদ্যুৎ আইন প্রণয়ন করা হয়, যখন এই অঞ্চলের গ্রাম ছিল পুরোপুরি অন্ধকারে আর শহরের সব জায়গায়ও বিদ্যুৎ ছিল না।
বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, এখন দেশের ৭৭ শতাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছেছে। আর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন অচিরেই প্রায় ১০ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছে যাবে।রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন হলে দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা পুরোপুরি মিটানো সম্ভব হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মন্ত্রী বেনারকে জানান, “একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাড়ছে এবং এর পাশাপাশি বাড়ছে ঝুঁকিও। এর আগে বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলার ঘটনাও ঘটেছে।”
আগে যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রে হামলা হয়েছে, এই আইনের আওতায় সেগুলোর বিচার হবে কিনা–এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম গতকাল সাংবাদিকদের জানান, আগের ঘটনাগুলো এই আইনের আওতায় পড়ার সুযোগ নেই।
এই প্রেক্ষাপটে সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে বিদ্যুৎ আইন নীতিগতভাবে অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। এতে একদিকে নতুন করে জেল-জরিমানার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, অন্যদিকে পুরোনো শাস্তির মাত্রাও বেড়েছে। বিদ্যুৎ আইনে শাস্তি
আইনে বলা হয়, বিদ্যুৎকেন্দ্র বা উপকেন্দ্র ছাড়াও পোল এবং যন্ত্রপাতির মতো বিদ্যুৎ স্থাপনা ধ্বংস করলে, নাশকতা বা অনিষ্ট সাধন করলে সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনিম্ন ৭ বছরের কারাদণ্ড হবে। একই সঙ্গে ১০ কোটি টাকা জরিমানাও দিতে হবে।
এতে আরও বলা হয়েছে, ব্যক্তি পর্যায়ে বিদ্যুৎ চুরি বা অবৈধভাবে বিদ্যুৎ-সংযোগ নিলে অনধিক তিন বছরের কারাদণ্ড বা চুরি করা বিদ্যুতের মূল্যের দ্বিগুণ জরিমানা বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা হবে।
আর শিল্প বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই দণ্ড অনধিক পাঁচ বছর এবং চুরি করা মূল্যের দ্বিগুণ জরিমানা বা এক লাখ টাকা জরিমানা করা হবে।
পুরোনো আইনে বিদ্যুৎ লাইন চুরির জন্য পাঁচ বছরের জেল ও ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান ছিল। তা বাড়িয়ে দুই থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা জরিমানার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া অবৈধভাবে নিজের মিটার থেকে অন্য কাউকে বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়া যাবে না। যদি কেউ দেয়, তাহলে তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।
বিদ্যুতের অনুচিত ব্যবহারের জন্য অনধিক তিন বছর জেল অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে নতুন আইনে।
ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধের প্রস্তাব প্রত্যাহার
নতুন আইনের এই খসড়ায় ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধের প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকদের জন্য। বিদ্যুৎ বিভাগে যেহেতু এখন কোনো শ্রমিক নেই, সবাই কর্মচারী, সেহেতু সেখানে ট্রেড ইউনিয়ন থাকা উচিত নয়। তা ছাড়া ইউনিয়ন থাকায় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অনেক ঘটনাও ঘটছে।
“এই সময়ে ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ করলে তার বাজে প্রভাব পড়বে। কেন এটা বন্ধ করা হয়েছে, সেটি না বুঝে দেশে-বিদেশে নানারকম সমালোচনা হবে। তাই প্রধানমন্ত্রীও মনে করেছেন এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়,” বেনারকে জানান শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু।
বৈঠক সূত্র জানায়, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান এবং ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ করা ঠিক হবে না বলে মত দেন।
আইনে নতুন বিষয়
এই আইনের আওতায় সমন্বয়ের ভিত্তিতে দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পরিচালনা করতে ইনডিপেনডেন্ট সিস্টেম অপারেটর (আইএসও) নামে একটি নতুন প্রতিষ্ঠান করা হবে। সারা দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা এই অপারেটরের অধীন নিয়ে আসা হবে।
আইনের আওতায় বিদ্যুতের চুরি শনাক্ত ও রোধে এবং বিদ্যুতের অপব্যবহার প্রতিরোধে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তার সমন্বয়ে বিদ্যুৎ গোয়েন্দা সেল গঠন করা হবে।এ ছাড়া প্রশাসনিকভাবে যে পাওয়ার সেল গঠন করা হয়েছে, সেটিকে নতুন এ আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
বৈঠক শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম জানান, বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিতরণ ও সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন লাইসেন্স প্রদান করবে।
তিনি জানান, সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যক্তি বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভূমির সঙ্গে সংযুক্ত (আর্থিং) করতে পারবে না।
“১৯১০ সালে বিদ্যুৎ যে অবস্থায় ছিল ২০১৬ সালে এসে সেই অবস্থায় নেই। এমনকি এই সরকার ক্ষমতায় আসার শুরুর দিকে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো, এখন সেখানে তিনগুণ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়,” জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
বিদ্যুতের একাল–সেকাল
মাত্র ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতো ১৯৭২ সালে।বড় শহর ছাড়া কোথাও বিদ্যুত সংযোগ ছিল না। আবার সংযোগ থাকলেও বিদ্যুতের দেখা পাওয়া ছিল কঠিন। বর্তমানে উৎপাদন ৯ থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছেছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিদ্যুৎ পৌঁছেছে।
আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার ‘ভিশন ২০২১’ অনুযায়ী সরকার পরিকল্পনা করেছিল, ২০২০ সালের মধ্যে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর।
“প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওয়াদা ছিল, ২০২১ সালে সব ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হবে। যেভাবে কাজ হচ্ছে তাতে ওই সময়ের আগেই সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে,” বেনারকে জানান বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
উল্লেখ্য,সংশোধিত পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালের মধ্যে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা হবে ২৪ হাজার মেগাওয়াট, ২০২৫ সালে ৩০ হাজার মেগাওয়াট আর ২০৩০ সালে ৪০ হাজার মেগাওয়াট।