রানা প্লাজা ধ্বসে আহতদের মধ্যে ৭৯ শতাংশই ব্যবসা করতে চায়
2016.04.18

রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় বেঁচে থাকা শ্রমিকদের সিংহভাগই পোশাক শিল্পকারখানার কাজে ফিরতে আগ্রহী নন। এদের প্রায় ৭৯ শতাংশ নিজেরাই ব্যবসা করতে চান বলে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের এক জরিপে উঠে এসেছে।
তবে তাদের এই ব্যবসার ক্ষেত্রে পুঁজি সবচেয়ে বড় বাঁধা। আহত শ্রমিক কিংবা নিহতের পরিবাররা বিভিন্ন সহায়তা পেলেও এর বড় অংশ ওষুধসহ সংসারের দৈনন্দিন কাজে খরচ হয়েছে।
এক হাজার ৩০০ আহত শ্রমিকের অংশ নেওয়া ওই জরিপ বলছে, রানা প্লাজার ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার ৪৮ শতাংশ শ্রমিক এখনো বেকার। শারীরিক ও মানসিক সমস্যার কারণে এখনো কাজে ফিরতে পারছেন না তারা। আর এই বেঁচে থাকা শ্রমিকদের প্রায় ৫৯ ভাগই দীর্ঘমেয়াদি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।
রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে গত শনিবার ‘বহু পাক্ষিক সংলাপ: রানা প্লাজা ধসের তিন বছর ও পোশাকশিল্পের অগ্রগতি’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে তৃতীয়বারের মতো রানা প্লাজা শ্রমিকদের নিয়ে জরিপ করল অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ।
সংস্থাটির এ দেশীয় পরিচালক ফারাহ কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে জরিপের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন অ্যাকশনএইডের কর্মকর্তা নুজহাত জেবিন। সেদিনের দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের বর্তমান পরিস্থিতির পাশাপাশি পোশাক খাতের অগ্রগতিও অনুষ্ঠানে গুরুত্ব পায়।
যে খাতে ব্যয় হয় শ্রমিকদের প্রাপ্ত আর্থিক সাহায্য
অ্যাকশন এইড জরিপে দেখা গেছে, প্রাপ্ত আর্থিক সাহায্যের বড় একটা অংশ খরচ হয়েছে শ্রমিকদের সংসারের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে। এর মধ্যে ৩৩ ভাগই ধার ঋণ শোধ করতে খরচ হয়েছে। খাবার, ওষুধ ও সংসারের দৈনন্দিন কাজে খরচ হয় ৪৯ ভাগ। আর সঞ্চয় বা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে খরচ হয়েছে ১৬ ভাগ।
এ ছাড়া অর্থ সুবিধা দফায় দফায় দেওয়ার কারণে শ্রমিকেরা তা এককালীন কোনো কাজে লাগাতে পারেনি।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘শ্রমিকদের জন্য যে সহায়তা দেওয়া হয়েছে সেটা পূর্ণাঙ্গ নয়। তাদের কর্মসংস্থান, পুনর্বাসনের জন্য যা করা হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।’
অ্যাকশন এইড প্রতিবেদন বলছে, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিকদের ২০ ভাগেরই পরিবারে ২ জন করে নির্ভরশীল সদস্য রয়েছে। ২৩ ভাগের আছে ৪ জন করে নির্ভরশীল সদস্য। এখন ওই শ্রমিকেরা যা আয় করেন তার ৬১ ভাগ চলে যায় খাবারে। আয়ের প্রায় ১৬ ভাগ যাচ্ছে ঘর ভাড়ায়। তারা মাত্র ৮ ভাগ টাকা খরচ করতে পারেন চিকিৎসার ক্ষেত্রে।
‘ক্ষতিপূরণ পায়নি শ্রমিকেরা’ অ্যাকশন এইড
অ্যাকশনএইডের প্রতিবেদনে বলা হয়, গার্মেন্টস মালিক, ক্রেতা ও সরকার ক্ষতিপূরণের বিষয়ে নানা সময় নানা উদ্যোগ নিয়েছে।তবে শ্রমিকেরা যা পেয়েছে, সে অর্থ আসলে তাদের সার্বিক চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, ‘এখন পর্যন্ত শ্রমিকদের যা দেওয়া হয়েছে সেটা আর্থিক সহযোগিতা। ক্ষতিপূরণ নয়। ক্ষতিপূরণ বললেই শ্রমিকের মানসিক, সামাজিক ও আর্থিক বিষয়গুলো চলে আসবে।’
এ বিষয়ে ড. মোয়াজ্জেম বলেন, ‘অনেক উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। তবে সমন্বিত কোনো উদ্যোগ নেই। নানাভাবে অ্যাকশনএইড, ব্র্যাক বা সরকার কাজ করছে। তবে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। এখন আসলে সময় এসেছে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি তৈরি করার।’
পোশাক শিল্পে ফিরতে চান মাত্র ৫ শতাংশ
অ্যাকশন এইড প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সুস্থ হয়ে ওঠাদের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ শ্রমিক আবারও পোশাক শিল্পের কাজে ফিরতে চান। তবে বেশির ভাগই এ পেশা থেকে দূরে থাকতে চান সেই দুর্বিষহ দুর্ঘটনা ভোলার জন্য।
অ্যাকশন এইডের প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে আহত শ্রমিক নাজমা আক্তার বলেন, ‘সেদিনের ঘটনায় আমি শরীরে প্রচণ্ড আঘাত পাই। এখন গার্মেন্টসে ফিরে যেতে চাই না। সেই ঘটনা আমি ভুলতে পারি না।’
তবে গত ৩ বছরের জরিপ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় আহত শ্রমিকদের কাজে ফেরার হার ক্রমবর্ধমান। একইসঙ্গে বেকারত্বের হারও কমে গেছে। এ বছরের তথ্যে দেখা যায়, আহত শ্রমিকদের শতকরা ৫২ জন চাকরি বা স্ব-কর্মসংস্থানের সাথে যুক্ত হয়েছেন। এদের একটি অংশ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা থেকে প্রশিক্ষণও নিয়েছন।
রানা প্লাজায় থাকা ইথার টেক্সট-এ কাজ করা রফিক খান বলেন, ‘আমি এখনো ভাল হতে পারিনি। সাভারে কিছু প্রশিক্ষণ পেয়েছি। সেটা দিয়ে একটা দোকান দিয়েছি। এখন আর গার্মেন্টস এ কাজ করতে চাই না।’
‘শ্রমিকের হাত যেন ভিক্ষুকের হাত না হয়’
এসব খেটে যাওয়া শ্রমিকেরা যেন সঠিকভাবে পুনর্বাসিত হয় সে দিকে নজর দিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন শ্রমিক নেতারা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা রাজেকুজ্জামান রতন বেনারকে বলেন, ‘দুর্ঘটনা থেকে ফিরে আসা শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক দুই ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।
মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে গেলে তারা একই ধরনের কাজ করতে ভয় পান। কাজে অনীহা বৃদ্ধি পায়। তখন তার মানসিক পুনর্বাসন দরকার।’
“আর যারা শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া শ্রমিক,তাদের হাত যেন ভিক্ষুকের হাতে পরিণত না হয়। এ জন্য সুচিকিৎসার পাশাপাশি তাদের বিকল্প কর্মসংস্থান প্রয়োজন,” জানান রাজেকুজ্জামান।