শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সাংসদদের প্রভাব কমাতে আদালতের রায়
2016.06.01

গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনা কমিটির কর্মকাণ্ড নিয়ে এক ধরনের নৈরাজ্য চলে আসছে। এরই মধ্যে গতকাল বুধবার হাইকোর্টের দেওয়া রায় বিশ্লেষন করে আইনজ্ঞরা বলছেন, কেবল পদাধিকার বলে সাংসদেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির সভাপতি হতে পারবেন না।
উচ্চ আদালতের দেওয়া এমন রায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কিছুটা কমবে বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলছেন, দেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা নিয়ে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও খবরদারি বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে এই রায় কিছুটা স্বস্তি আনতে পারে।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ রায় ঘোষণার পর সাংবাদিকদের বলেছেন, 'হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর বিষয়টি পর্যালোচনা করে পদক্ষেপ নেবে মন্ত্রণালয়'।
“এই রায়ের ফলে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি, নিয়োগ ও অন্যান্য বাণিজ্য বন্ধ হবে,” বেনারকে জানান রিট আবেদনকারী আইনজীবী ইউনূছ আলী আকন্দ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, দেশে প্রায় ৩৭ হাজার বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলোর বেশিরভাগই নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় সাংসদ কিংবা তাঁদের সমর্থনপুষ্ট স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা।একজন সাংসদ তাঁর নিজ নির্বাচনী এলাকার সর্বোচ্চ চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতে পারেন। তবে তাঁর নির্বাচনী এলাকার অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির সভাপতি কে হবেন, তা সাংসদের পরামর্শেই ঠিক হয়।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, এই প্রক্রিয়ায় দেশের বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি দলের স্থানীয় নেতারা ঢুকে পড়েছেন। তাঁদের কাছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানেরা অনেকক্ষেত্রে অসহায় হয়ে পড়েন।
এ প্রসঙ্গে প্রবীণ শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ মাজহারুল হান্নান বেনারকে বলেন, “কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া শিক্ষকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা কমিটিতে পরিবর্তন আনা দরকার।”তিনি আরও বলেন, ‘এখন শিক্ষা ব্যবস্থায় নানা পরিবর্তন আসছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায়ও পরিবর্তন আনতে হবে, যার মাধ্যমে শিক্ষকেরা স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন’।
২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর নতুন এই প্রবিধান চালু করে। ওই প্রবিধানের ৫(২) ধারা আদালত অবৈধ ঘোষণা করায় এখন সাংসদরা অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেই আর সর্বোচ্চ চারটি স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতে পারবেন না। তবে ৫(১) বিধি অনুসারে সাংসদদের সর্বোচ্চ চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি নির্বাচিত হতে বাধা নেই।
আদালতের আদেশের পর এখন চারটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি সাংসদ হতে পারেন। তবে তাঁকে নির্বাচিত হতে হবে। সে ক্ষেত্রে পরিচালনা কমিটির অন্যান্য সদস্যের ভোটে তাঁকে সভাপতি নির্বাচিত হতে হবে।
এখনকার প্রবিধানে উল্লেখ না থাকলেও একজন সাংসদ অনানুষ্ঠানিক পত্র দিয়ে নিজ দলের স্থানীয় কোনো নেতার নাম উল্লেখ করে তাঁকে সভাপতি বা সদস্য করার অনুরোধ জানান। এই অনুরোধ শিক্ষাবোর্ড সচরাচর উপেক্ষা করে না। বরং সাংসদের চিঠি তাঁরা গুরুত্ব দেয়।
রাজধানীর মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ইসহাক হোসেন বেনারকে বলেন, “শিক্ষানুরাগীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার নেতৃত্বে আসা উচিত। প্রবিধানে এই সুযোগ থাকলেও রাজনৈতিক চাপে তাঁরা হারিয়ে যান।” তাঁর মতে, রাজনৈতিক কারণে যাঁরা কমিটিতে আসেন তাঁদের অনেকেই যথেষ্ট শিক্ষিত নন এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা কম।
বিশেষ কমিটি আর নয়
হাইকোর্ট গতকাল বিশেষ ধরনের গভর্নিং বডি বা ম্যানেজিং কমিটি-সংক্রান্ত প্রবিধান মালার ৫০ বিধি বাতিল করেছেন। এতে বলা হয়েছে, বিশেষ পরিস্থিতিতে বোর্ড এবং সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কোনো বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ ধরনের গভর্নিং বডি বা ক্ষেত্রমতে ম্যানেজিং কমিটি গঠন করা যাবে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষেত্রবিশেষ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার এই বিধি ব্যবহার করত।
“আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের হাতে বিশেষ কমিটি করার এখতিয়ার রাখতে হবে। এটা না থাকলে নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সরকারের কিছুই করণীয় থাকবে না,” বেনারকে জানান মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফাহিমা খাতুন।
উল্লেখ্য, ওই বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি সম্প্রতি স্থানীয় সাংসদ সেলিম ওসমানের নির্দেশে প্রধান শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করে। ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে ওই শিক্ষককে সাংসদের উপস্থিতিতে কান ধরে উঠ–বস করানো হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুলের ওই পরিচালনা কমিটি বাতিল করে এবং প্রধান শিক্ষকের চাকরি ফিরিয়ে দেয়।