ঈদের দিনটিও ছাড় দিল না জঙ্গিরা,শোলাকিয়ায় দুই পুলিশসহ নিহত ৪
2016.07.07

গুলশান হামলার সপ্তাহ না ঘুরতেই আরেকটি রক্তাক্ত হামলা, তাও আবার মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরের দিন।ওই হামলায় দুই পুলিশ ও এক নারী নিহত হয়েছেন। মারা গেছে একজন হামলাকারীও।
এবারের লক্ষ্যস্থল কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ময়দান, যেখানে দেশের সবচেয়ে বড় ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়। ওই ময়দানে প্রায় তিন লাখ মুসল্লী ঈদের নামাজ আদায় করেন।
গত মাসে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের ইমাম মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদের নেতৃত্বে ঘোষিত এক ফতোয়ায় জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদকে হারাম ঘোষণা হয়। এক লাখের বেশি আলেম–ওলামা ও মুফতি ওই ফতোয়ায় সই করেন।
গতকালের ঘটনার পর মুফতি মাসউদ স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, হামলার লক্ষ্য তিনিও হতে পারেন। এর আগে তাঁকে বেশ কয়েকবার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ঘটনার কারণে গতকাল তিনি ঈদের জামাতে ইমামতি করতে পারেননি।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের প্রায় চারশ’ গজ দূরে প্রথমে পুলিশের একটি দলের ওপর হামলা চালানো হয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে হামলাকারীদের গোলাগুলি হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল গণভবনে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে বলেন, ইসলামের কথা বলে যারা এ ধরনের হামলা ও হত্যা চালাচ্ছে তারা ইসলামের শত্রু।
আর বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, এভাবে নিরাপরাধ মানুষকে যারা হত্যা করেছে তারা ভীরু ও কাপুরুষ।
গত বৃহস্পতিবার ইসলামিক স্টেট—আইএসের পক্ষ থেকে একটি নতুন ভিডিও প্রকাশ করা হয়, যাতে গুলশান হামলার ধারাবাহিকতায় আরও হামলার কথা বলা হয়। এ নিয়ে দেশজুড়ে এক ধরণের আতঙ্ক বিরাজ করছে। গতকাল ওই ঘটনার পর অনেকেরই ঈদের আনন্দ ম্লান হয়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা ও পুলিশ জানায়, সকাল পৌনে নয়টার দিকে মুসল্লিরা যখন নামাজের জন্য শোলাকিয়া মাঠে যাচ্ছিলেন তখন আজিমউদ্দীন স্কুল সংলগ্ন মুফতি মোহাম্মদ আলী মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের একটি দলের ওপর বোমা হামলা চালায় সন্ত্রাসিরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা এসময় চাপাতি ও আগ্নেয়াস্ত্র হাতে কয়েকজনকে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখে।
পুলিশ জানিয়েছে, বোমা হামলার পরে কয়েকজন হামলাকারী আজিমউদ্দীন স্কুলের আশপাশের বাড়িতে গিয়ে ঢুকে পুলিশের ওপর বোমা ছোড়ে ও গুলি চালায়। এসময় পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি পাল্টা গুলি ছোড়ে।
দুপুর একটার দিকে পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ দুই সন্দেহভাজন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে। এরা হচ্ছে; শরীফুল ইসলাম ওরফে আবু মুকাতিল ও জাহিদুল হক।
এছাড়া ঘটনাস্থল থেকে আব্দুল হান্নান বাবুল নামে এক স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও মামুন নামে একজন তরুণকে আটক করেছে পুলিশ।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সৈয়দ আবু সায়েম বেনারকে বলেন, “তল্লাশী চৌকিতে দায়িত্ব পালনরত একদল পুলিশকে লক্ষ্য করে প্রথমে বোমা ছোড়া হয়। এরপর সন্ত্রাসীরা তাঁদের কুপিয়ে আহত করে, একপর্যায়ে গুলি ছোঁড়ে।”
তিনি জানান, এ সময় পাশে থাকা পুলিশের আরেকটি দল ছুটে এসে গুলি চালায়। জঙ্গিরা তখন পালিয়ে আশে পাশের বাড়ি ঘরে ঢুকে পড়ে। দীর্ঘ সময় অভিযান চালিয়ে তাদের নিবৃত করা হয়।
পুলিশ জানায়, এ ঘটনায় দুই পুলিশসহ চারজন নিহত হয়েছেন। নিহত পুলিশ সদস্যরা হলেন জহিরুল হক ও আনসারুল্লাহ। এছাড়া ঘটনার সময় নিজের বাড়িতে থাকা ঝর্ণা রানী ভৌমিক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। নিহত সন্ত্রাসীর পরিচয় মেলেনি।
ওই ঘটনায় ১০ পুলিশ সদস্যসহ ১২জন আহত হয়েছেন। ছয়জন পুলিশ সদস্যকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নেওয়া হয়। এ ছাড়া আরো কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে ময়মনসিংহে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ দুটি পিস্তল, একটি চাপাতি, একটি অবিস্ফোরিত হাতে তৈরি গ্রেনেড (আইইডি- ইমপ্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) উদ্ধার করেছে।
“ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার করা দুই জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এরা দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। এদের একজন দিনাজপুরের শরীফুল ওরফে আবু মুকাতিল বলেছেন, কোনো এক ওস্তাদের নির্দেশে তারা এখানে হামলা চালাতে এসেছিলেন,” বেনারকে জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান।
মুফতি মাহমুদ জানান, “নিহত সন্দেহভাজনের পরনে ছিল নীল রঙের কাবলি সেট (জোব্বা-পায়াজামা)। পরে দেখা যায়, তার পায়জামার নীচে হাঁটু পর্যন্ত চাপা জিন্সের প্যান্ট রয়েছে। সেই জিন্সের ডান থাইয়ের ওপরে বিশেষ কায়দায় লম্বা ছোরা রাখার একটি চেম্বার দেখা গেছে। তারা কোনো জঙ্গি সংগঠনের সদস্য কিনা, সে বিষয় স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি।”
ঝর্ণা রানীর নির্মম মৃত্যু
গোলাগুলির সময় নিজের শোয়ার ঘরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন গৃহবধূ ঝর্ণা রানী ভৌমিক। জানালা দিয়ে একটা গুলি এসে তাঁর মাথায় লাগে। ঘরের ভেতরেই পড়ে যান তিনি। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
ঝর্ণার বড় ছেলে বাসুদেব ভৌমিক ঢাকার একটি কলেজের শিক্ষক। স্থানীয় সাংবাদিকদের তিনি বলছিলেন, “কেমন করে বিশ্বাস করব যে, আমার মা নেই। মায়ের ঘরটা ভেসে গেলো মায়েরই রক্তে।”
ঝর্ণার স্বামীর নাম গৌরাঙ্গ ভৌমিক, তিনি একটি তামাক কারখানার কর্মী।
গুলশান হামলার ধারাবাহিকতা!
এর আগে গত শুক্রবার রাতে রাজধানীর গুলশানের অভিজাত রেস্তোরাঁ হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে জিম্মি করে হত্যাযজ্ঞ চালায় জঙ্গিরা। সেখানে ১৭ বিদেশী, দুই বাংলাদেশী ও একজন দ্বৈত নাগরিককে তারা গুলি ও জবাই করে হত্যা করে।
জিম্মিদের উদ্ধারে গিয়ে জঙ্গিদের হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। এ ছাড়া জিম্মিদের ছাড়াতে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের সমন্বিত অভিযানে পাঁচ সন্দেহভাজন জঙ্গি ও ওই রেস্তোরাঁর এক কর্মী নিহত হন। পুলিশের দাবি রেস্তোরাঁর কর্মী যাকে বলা হচ্ছে, তিনি জঙ্গিদের সহযোগিতা করেছিলেন।
যদিও পুলিশের দাবি জেএমবি’র জঙ্গিরা ওই ঘটনা ঘটিয়েছে, তবে শুরু থেকেই ওই ঘটনার দায় স্বীকার করে আসছিল আইএস ও তাদের কথিত বার্তা সংস্থা আমাক।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঢাকা রেঞ্জের ডিআিইজি মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেছেন, যে চক্রটি গুলশানের হামলার সঙ্গে জড়িত তারাই এ হামলা চালাতে পারে। তিনি ধর্মের নামে উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সর্বস্তরের নাগরিকদের সহযোগিতা কামনা করেন।